ঘাটাইলে দুই শিক্ষকের অবৈধ নিয়োগ নিয়ে সরকারী টাকা আত্নসাৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘী উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে অবৈধভাবে নিয়োগ নিয়ে সরকারি ১৮ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ উঠেছে হাসিনা খাতুন ও সুফিয়া আক্তারের বিরুদ্ধে। হাসিনা খাতুন ও সুফিয়া আক্তার ২০১৮ইং সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ৫৪ মাস যাবৎ শিক্ষকতায় বহাল তবিয়তে। বিগত ৫৪ মাসে অবৈধ নিয়োগে এমপিও এর মাধ্যমে মাসিক বেতন বাবদ সরকারি ১৮ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

জানাগেছে, হাসিনা খাতুন ও সুফিয়া আক্তার সহকারী শিক্ষক (সমাজ বিজ্ঞান) পদে ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারী সাগরদিঘী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যা সম্পূর্ণ জালিয়াতি,স্বজনপ্রীতি এবং মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করার পূর্বেই হাসিনা খাতুন ও সুফিয়া আক্তার সাগরদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (সমাজ বিজ্ঞান) পদে নিয়োগ পান। যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বিধি বর্হিভুত ভাবে। ততকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম শামছুল হক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করা ছাড়াই সাথে নিয়োগ পক্রিয়া সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে চাকুরী বৈধ করতে বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক হুমায়ন খালিদ ভূইয়া, ততকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম শামছুল হক, ও শিক্ষক প্রতিনিধি নসরত উল্লাহর যোগসাজশে তাদেরকে চুড়ান্ত নিয়োগ ও এমপিও ভুক্ত করা হয়। চাকরিচ্যুত হুমায়ূন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দূর্নীতিবাজ শিক্ষা অফিসার (তত্কালীন) একে এম শামছুল হক ও নসরত উল্লাহর যোগসাজশে হাসিনা ও সুফিয়ার এম পি ও করেন ১৮ই জুলাই ২০১৮ সালে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া হাসিনা ও সুফিয়া এমপিও ভুক্ত হলেও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম শামছুল হকের চাহিদা মত ঘুষ দিতে নাপারায় এমপিও হয়নি সহকারী শিক্ষক(ব্যবসায় শিক্ষা) পদে নিয়োগ পাওয়া ওমর ফারুকের। এনিয়ে স্কুলের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি এবং স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।

ম্যানেজিং কমিটি হাসিনা ও সুফিয়া কিভাবে এমপিও ভুক্ত হলেন তা বের করতে উঠে পড়ে লাগেন। কমিটির সাথে দৌড়ঝাপ শুরু করেন এমপিও না হওয়া ওমর ফারুক এবং এরসাথে যুক্ত হন শিক্ষকদের কেউ কেউ। তারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে হাসিনা ও সুফিয়ার সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। এতেই বের হয়ে আসে হুমায়ন খালিদ ও শিক্ষক প্রতিনিধি নসরত উল্লাহর অনিয়ম জালিয়াতি ও দুর্নীতি। প্রধান শিক্ষক হুমায়ূন খালিদ তার স্ত্রী হাসিনা খাতুন এবং নিয়োগ বোর্ডের শিক্ষক প্রতিনিধি মনোনীত হওয়া নসরত উল্লাহর স্ত্রী সুফিয়া আক্তারকে নিয়োগ দিতে ভুয়া কাগজ তৈরি করেন। সভাপতির স্বাক্ষর জাল,ডিজির প্রতিনিধি মঞ্জুশ্রী রায়কে না জানিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সাথে যোগসাজশে জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেন প্রধান শিক্ষক হুমায়ন খালিদ ভূইয়া। প্রধান শিক্ষক হুমায়ূন খালিদ ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে মানবজমিন ও প্রগতির আলো পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করান । বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিন হইতে ১৫ দিনের মধ্যে চাকুরি প্রার্থীদের আবেদন করতে বলা হয়।

কিন্তু পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাতে কেউ আবেদন করতে না এবং বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে জানতে না পারে তাই ঘাটাইলে আসা সকল পত্রিকা গোপন করে রাখে প্রধান শিক্ষক হুমায়ূন খালিদ ভূইয়া । বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকেও জানানো হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ৪ জন সমাজ বিজ্ঞান (মহিলা), ১ জন গণিত বি এস সি , ১ জন ধর্ম (ইসলাম), ১ জন ধর্ম (হিন্দু), ১ জন ব্যাবসায় শিক্ষায় শিক্ষক পদে দরখাস্ত আহবান করা হয়। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন করলে ১ জানুয়ারী ২০১৫ তারিখে আবেদনের শেষ দিন। আর সেক্ষেত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক অভিযুক্ত ২ জন শিক্ষক আবেদন করতে পারেন না। কারণ তাদের নিবন্ধন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ৯ মার্চ ২০১৫ । যা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬৯ দিন পর। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি অবগত ছিলেন না বলে লিখিত জানিয়েছেন ততকালিন সভাপতি। ডিজির প্রতিনিধিরাও ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন না মর্মে মঞ্জুশ্রী রায় (ডিজির প্রতিনিধি , সাবেক প্রধান শিক্ষক বাসাইল গোবিন্দ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) লিখিতভাবে জানিয়েছেন। যা না থাকলে বোর্ড গঠন করা যায় না। আর বোর্ড গঠন ছাড়া নিয়োগ হলে তা নিশ্চিত ভাবেই জালিয়াতির মাধ্যমে এবং তা অবৈধ। হাসিনা খাতুন ও সুফিয়া আক্তারকে অবৈধ ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে ততকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম শামছুল হক, প্রধান শিক্ষক হুমায়ূন খালিদ, সহকারী শিক্ষক নসরত উল্লাহ (সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি স্কুল ম্যানেজিং কমিটি) জড়িত থাকার পরও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ কে এম শামছুল হক এবং সহকারী শিক্ষক নসরত উল্লাহ বহাল তবিয়তে রয়েছেন। হাসিনা ও সুফিয়া কে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়ার অপরাধে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল এন্ড আরবিট্রেশন বোর্ড চাকরি দাতা হুমায়ূন খালিদ ভুঁইয়াকে তদন্ত সাপেক্ষে চাকরিচ্যুত করেন। এর প্রেক্ষিতে হুমায়ূন খালিদ ভূইয়া চাকরি ফেরত পেতে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিট পিটিশন নং ৪৪/২৩-২০২১। রিট পিটিশনটি যাচাই-বাছাই করে মহামান্য আদালত তা খারিজ করে দেওয়ার ফলে চাকুরীচ্যুত প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন খালিদের শেষ চেষ্টাও বিফলে যায়।

তবে হুমায়ূন খালিদকে চাকরিচ্যুত করা হলেও শাস্তির আওতায় আসেনি একে এম শামছুল হক, নসরত উল্লাহ, হাসিনা এবং সুফিয়া। তাদের অনিয়ম দুর্নীতি তুলে গত ৬/৯/২০২০ এবং ৯/৯/২০২০ স্থানীয় “দৈনিক মজলুমের কণ্ঠ” পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জেলা প্রশাসন টাঙ্গাইল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে উক্ত বিষয়টি তদন্ত করেন।

কিন্তু তদন্ত আজও আলোর মুখ দেখেনি।এছাড়াও ২০১৮ সালে সাগরদীঘি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গোলাম মোস্তফা,আবুল কালাম ও রুমা আক্তার এন্টিআরসিতে অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা এর সহকারী পরিচালক দূর্গা রানী সিকদার স্বাক্ষরিত ১৫/৪জি১২০২-ম/০৭/১৫০০০/৭ নং স্মারকে ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসার মো: রফিকুল ইসলামকে সরেজমিন তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তিনি সরেজমিনে তদন্ত করলেও কোন অর্দশ্য কারণে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেননি। সর্বশেষ প্রধান শিক্ষক রহমত উল্লাহ (ভারপ্রাপ্ত) মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করে বিষয়টি নজরে আনলে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক(উ.মা.) জাহিদ বক্ত চৌধুরীকে সরজমিনে তদন্তের নির্দেশনা প্রদান করেন । যা তদন্ত শেষে প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এবিষয়ে সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম রিপন বলেন, শিক্ষক সংকট থাকায় হাসিনা সুফিয়া আক্তারকে দিয়ে মৌখিক অনুমতি সাপেক্ষে ক্লাস করানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের নিয়োগ বিষয়ে কমিটির কেউ অবগত ছিল বলে আমার জানা নাই। চাকুরীচ্যুত প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন খালিদ ভূইয়া, শিক্ষক প্রতিনিধি নুসরত উল্লাহ এবং ঐসময়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন।

সাগরদিঘী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব এসকান্দর হক জানান, এই দুই শিক্ষকের নিয়োগ হয়েছে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পূর্বে( সাবেক কমিটির সময়) এই বিষয়ে প্রধান শিক্ষক রহমত উল্লাহ ভালো বলতে পারবে। তবে অবৈধভাবে নিয়োগ নিয়েছে বলে শুনেছি। এবিষয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত হয়েছে ইতোমধ্যে রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় আছি। রিপোর্ট পেলে বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এবিষয়ে সাগরদিঘী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) রহমত উল্লাহ বলেন,আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটির নির্দেশনামতে, সহকারী শিক্ষক হাসিনা ও সুফিয়াকে তাদের কাগজপত্র উপস্থাপন করতে বলি। বার বার কাগজপত্র জমা দিতে বললেও তা জমা না দেওয়ায় আমি তাদেরকে শোকজ করি । তবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী শিক্ষকদের জমা দেওয়া অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের কাগজপত্র দেখে তাদের নিয়োগ অবৈধ এবং জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু হাসিনা ও সুফিয়া কাগজপত্র উপস্থাপন না করে আমার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মোকদ্দমা দায়ের করে। মোকদ্দমা দায়েরের ফলে আমি আর কোন ব্যবস্হা নিতে পারিনা। যেহেতু আদালতের বিষয়। আর এই বিষয়টি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারও জানেন।

ততকালীন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার( বর্তমানে উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জে কর্মরত) একেএম শামসুল হক এর কাছে এই বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক আগের বিষয় যতদূর মনে পড়ে তাদের নিয়োগ যথাযথ পক্রিয়াতেই সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা এখন কর্মরত রয়েছেন স্কুলটিতে। কোন অনিয়ম হয়নি।

ধারাবাহিক চলবে…..