বন্ধুত্বের অনন্য পঞ্চাশে বাংলাদেশ-ভারত

রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ।। ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক: আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর পূর্বে ১৯৭১ -এ পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন করে যুক্ত হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামটি। দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক যুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের জয়ে সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পুনরায় বদল ঘটে উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সীমানার। ভেঙ্গে যায় নিছক কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে রূপ নেয়া জিন্নাহর পোকায় খাওয়া পাকিস্তান।

ব্রিটিশরা যখন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে, তখনই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশের লোকের অভাব ছিলো না মোটেও! কেননা, ভৌগলিক হিসেবে পাকিস্তানের দুই অংশ, যথাঃ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ছিলো প্রায় দু হাজার মাইলের বিস্তর ফারাক এবং দুই অংশের মাঝখানে এসে পড়ে বিশাল ভারতীয় ভূখন্ড। উভয় অংশের মানুষের মধ্যে ছিলো ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অমিল। তাছাড়া, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ যথাযথভাবে গ্রহণ করেনি সদা বিপ্লবী বাঙালী জনতা। তাই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাকে শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন তৎকালীন বোদ্ধাগণ।

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরও বাংলাদেশের সাধারণ জনতা প্রায় আড়াই দশক সময়কাল পাক শাসকদের অধীনে দেশ গঠনে মন দিয়েছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত শোষণ, পাঞ্জাবি-পাঠানদের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য, পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাম্ভিক আভিজাত্য -সবকিছু মিলে বাঙালীদের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিলো, তা ইসলামাবাদের সংবেদনশীল, নিষ্ক্রিয় সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসকেরা সঠিকভাবে বিচার করতে ব্যর্থ হয়। অনিবার্য হয়ে উঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম।

আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথচলার শুরু ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেন জিন্নাহ। অথচ তিনি নিজে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানীরাও ব্যাপকভাবে উর্দুভাষী ছিলেন না। ফলত, নিজের জীবদ্দশাতেই ১৯৪৮ -এ ঢাকায় ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন পাকিস্তানের জাতির জনক।

এরপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী যা ঘটেছিলো, সেটি মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পৃথিবীর ইতিহাসেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলি চালায় তৎকালীন পাক সরকার। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ছাত্র ও সাধারণ জনতাকে। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে জীবন দেয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।

তবে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে প্রথম দ্বিমত দেখা দিলেও বাঙালীরা পাকিস্তানে শোষণের শিকার হয়েছে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ভৌগলিকভাবে সব ধরণের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জিন্নাহর সম্মানে দেশের রাজধানী ঢাকায় স্থাপন না করে করাচিতে করতে রাজি হয় পূর্ব বাংলার মানুষ।

বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং উন্নয়নের দিক থেকেও শোষিত হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান। তখনও অবধি পাকিস্তানের রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ আসতো পূর্ব বাংলায় উৎপাদিত পাট থেকে। কিন্তু এই আয়ের বেশিরভাগই খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পাক শাসকদের বৈষম্যমূলক নীতি বাংলার মানুষের মুক্তির সমাবেশস্থলে পরিণত হতে সময় নেয়নি। শুরু হয় বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। ভাষা ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন মিলে দীর্ঘ ২৪ বছরে তৈরী হয় বাংলাদেশের মুক্তির প্রেক্ষাপট। উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের উত্থান ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী এক ঘটনা। যে সময়ে বাংলাদেশের জন্ম, তখন গোটা বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের দুই ধারায় বিভক্ত। তাই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সমর্থন দেয়ায় ভারতও বিশ্বব্যাপী নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে থাকে।

ইতিহাস ঘাটলেই আমরা দেখতে পাই, সত্তরের দশকের প্রারম্ভিক পর্যায়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং আলোচনার দ্বার উমুক্ত করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য পাকিস্তানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছিলো নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। তাই স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন যায় পাকিস্তানের দিকে।

অন্যদিকে, ভূ-রাজনৈতিক, আদর্শিক কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভারতের পাশে এসে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের সমর্থন পেয়ে মুক্তিযুদ্ধকে আরও ত্বরান্বিত করে ভারত। যুদ্ধে সত্যের জয় হয়। জয় হয় সাধারণ বাঙালী জনতার। জয় হয় খেঁটে খাওয়া মানুষের। জয় হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দৃঢ়তার।

তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, পাকিস্তানকে ব্যবহার করে চীনের সঙ্গে আলোচনার দ্বার ঠিকই উন্মোচন করতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সক্রিয় সমর্থন দিয়েও পাকিস্তানের ভাঙন আটকাতে পারেনি দেশটি। পাকিস্তান ও চীনের যৌথ প্রয়াসেও ব্যর্থ করা যায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। সফল হয় ভারতীয় প্রচেষ্টার।

আজ একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বসে আমরা ধারণা করতে পারি, প্রথমদিকে ভারতের জন্য হয়তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের ভাঙন বা নিজেদের পূর্বে একটি শত্রু ফ্রন্ট অপসারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে খুব শীঘ্রই এটি একটি মানবিক যুদ্ধে পরিণত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াস এবং সাহসী ভূমিকা বিশ্লেষণ করলেই আমরা তা বুঝতে পারি।

একটি কথা না বললেই নয়, প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের নীতি সর্বদাই প্রাচীন কৌটিল্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ভারত সবসময়ই নিজের প্রতিবেশীদের সবার উপরে স্থান দিয়ে এসেছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে যখন দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখনও মসনদে বসেই ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির কথা ঘোষণা দেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।