পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিধিমালা: সেবা দিতে বাধ্য পুত্রবধুও

ত্রিশাল প্রতিদিন ডেস্ক:: বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার জন্য পিতা-মাতা ভরণপোষণ আইন পাস করা হয় ২০১৩ সালে। কিন্তু আইন পাসের ৬ বছর হলেও কোনো বিধিমালা ছিলো না এ আইনের অধীন। তাই সরকার এবার বিধিমালা তৈরী করতে যাচ্ছে। মূলত বিয়ের পর ছেলেরা যাতে বৃদ্ধ মা-বাবার সঠিকভাবে সেবা যত্ন করে সেজন্য এ আইন তৈরী করা হয়।

জানা যায়, ১০ এপ্রিল খসড়া এ বিধিমালা চূড়ান্ত করার লক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জুয়েনা আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘খসড়া চূড়ান্ত করে বিধিমালা জারি করা হবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে।’

প্রস্তাবিত এ খসড়া এ বিধিমালার ১৮ ধারায় বলা হয়, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার যথোপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তান নিজে উপস্থিত থাকতে না পারলে তার স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দিয়ে মা-বাবার উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। কোন কোন বিষয় পরিচর্যার আওতায় আসবে সেক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়, যত্ন সহকারে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, শৌচকার্য, সময়মতো ওষুধ-পথ্য ও খাবার খাওয়ানো, প্রয়োজনমতো বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে সকাল-বিকেল হাঁটানো বা ব্যায়াম করানোকে পরিচর্যা বোঝাবে।

খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, কোনো মা-বাবার একমাত্র ছেলে সস্ত্রীক চাকরি নিয়ে দূরে বা প্রবাসে থাকলে ‘উপযুক্ত প্রতিনিধির’ মাধ্যমে তাদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে উপযুক্ত প্রতিনিধি বলতে সন্তানের কোনো নিকটাত্মীয় চাচা, চাচি, ফুপা, ফুপু, মামা, মামি, খালা, খালু, ভাই, ভাবি, ভগ্নি, ভগ্নিপতি, শ্যালক, শ্যালিকা বা এ ধরনের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ, বিশ্বস্ত কর্মী বা প্রতিবেশীকে বোঝানো হয়েছে।

১১ ধারায় পিতা-মাতার ভরণপোষণের ন্যূনতম মানদন্ড নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘ভরণপোষণের ন্যূনতম মানদন্ডের ভিত্তি হইবে সন্তানের সামর্থ্য ও পিতা-মাতার যৌক্তিক প্রয়োজন সমন্বয়ের মাধ্যমে তাহাদের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমান।’ এ নিয়ে বলা হয়, প্রত্যেক সন্তান মা-বাবাকে সঙ্গে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। একাধিক সন্তান থাকলে মা-বাবা কোন সন্তানের সঙ্গে বসবাস করবেন, তা তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে।

সন্তান বা তার স্ত্রী-সন্তান মা-বাবার সেবা ঠিকমতো করছে কি না তা যাচাই করতে সারা দেশের ওয়ার্ড পর্যায়ে সহায়ক কমিটি থাকবে। এছাড়াও ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় পর্যায়ে এজন্য কমিটি থাকবে।

আবার কোনো মা-বাবার একটি মাত্র সন্তান থাকলে এবং কোনো উপযুক্ত কারণে একত্রে বসবাস না করলে ওই মা-বাবার ভরণপোষণের জন্য কী পরিমাণ অর্থ সন্তানকে দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেবে সহায়ক কমিটি। নির্ধারিত অর্থ সন্তান মা-বাবার জন্য ব্যয় করবে বা সরাসরি অথবা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠাবে। একাধিক সন্তান থাকলে এবং সন্তানরা একত্রে বাস না করলে মা-বাবার প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নির্ধারণ করে প্রত্যেক সন্তান সম্মিলিতভাবে নির্ধারিত অর্থ মা-বাবাকে দেবে। তবে মা-বাবা যে সন্তানের সঙ্গে থাকবে, সে সন্তানের আয় বিভাজন করে নগদ টাকা দিতে হবে না। মা-বাবার জন্য সন্তানরা শুধু টাকা দিলেই হবে না, বছরে অন্তত দু’বার সাক্ষাৎ করতে হবে।

অনেক সন্তান বা তার স্ত্রী মা-বাবার আচার-আচরণের সমালোচনা করেন। সেক্ষেত্রে সন্তান তার মা-বাবার কথা শুনবে, নাকি স্ত্রীর কথা শুনবে? এ নিয়ে বিরোধ হয় বউ-শাশুড়ির মধ্যে।

এই বিরোধ দূর করতে খসড়া এ বিধিমালায় মা-বাবার আচরণবিধি প্রসঙ্গে বলা হয়, মা-বাবা তাদের প্রয়োজন বা অনুভূতির কথা সন্তানদের একত্রে বা আলাদাভাবে জানাবেন। যেকোনো সংকটের কথা সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনা করে সংকটের সুরাহা না হলে পরিবারের অন্য সদস্য বা স্থানীয় ভরণপোষণ সহায়ক কমিটির সহায়তা নেবেন। মা-বাবা পরিবারের সবার প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন এবং শিশুসহ সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করবেন। মা-বাবার কোনো প্রয়োজন সন্তান তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে না পারলে বা দেরি হলে যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করবেন। শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের সেবাযত্ন নিজেরাই নেয়ার চেষ্টা করবেন। তাদের নিজস্ব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সুরক্ষার চেষ্টা করবেন।

মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের আচরণ কেমন হবে তা খসড়া বিধিমালার ১৩ ধারায় উল্লেখ করে বলা হয়, মা-বাবার সঙ্গে সর্বাবস্থায় মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হবে, যত্নসহকারে তাদের দেখভাল করতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় সেবা সুস্থতা, পথ্য ও অন্যান্য উপকরণ যথাসম্ভব দ্রুত সরবরাহ করতে হবে। কোনো প্রকার ছলচাতুরীর মাধ্যমে মা-বাবার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করবে না। মা-বাবার সম্পদে অন্য উত্তরাধিকারীদের অংশ আত্মসাতের চেষ্টা করবে না। মা-বাবার নিজস্ব কোনো সম্পদ না থাকলেও তাদের কোনোরূপ দোষারোপ করা যাবে না। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পিতা-মাতার অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।

খসড়া বিধিমালার ১৪ ধারায় মা-বাবার খাদ্য প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘পিতা-মাতার জন্য দৈনিক ন্যূনতম তিনবার বা পিতা-মাতার প্রয়োজন অনুসারে খাদ্য সরবরাহ করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, পিতা-মাতার বয়স, অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধিতা বিবেচনায় আনিয়া, প্রয়োজনে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুসারে নির্ধারিত পুষ্টিমান নিশ্চিত করিতে হইবে। বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবে পিতা-মাতার জন্য চিকিৎসকের বিধি-নিষেধ অনুসরণপূর্বক উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করিতে হইবে।’

ঋতু বিবেচনায় নিয়ে মা-বাবার পছন্দ ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনা করে তাদের জন্য আরামদায়ক পোশাক নির্দ্ধারণ করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বছরে যেকোনো একটি উৎসবে অতিরিক্ত এক সেট নতুন পোশাক সরবরাহ করতে হবে। সন্তানের আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে তাদের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষে রাখতে হবে। কক্ষটি সমতল জায়গা হতে হবে। তাদের জন্য বিছানাপত্র ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রাখতে হবে। তাদের শৌচকাজ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রবীণবান্ধব ব্যবস্থা থাকতে হবে।

খসড়া এ বিধিমালায় আরো বলা হয়, কোনো সন্তান বা তার স্ত্রী মা-বাবার উপযুক্ত ভরণপোষণ ও সেবা নিশ্চিত না করলে সে বিষয়ে সহায়ক কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন মা-বাবা। অভিযোগ পাওয়ার পর কমিটি সরেজমিনে গিয়ে মা-বাবা ও সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করবে। আলোচনার ভিত্তিতে তা সুরাহা না হলে কমিটি মা-বাবাকে অভিযোগ দাখিল করতে বলবে। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত তা নিষ্পত্তি করবে। এছাড়া সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ বা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করতে পারবে।

খসড়া এ বিধিমালার ২১ ধারায় ‘পিতা-মাতার মৃত্যুতে করণীয়’ শিরোনামে বলা হয়, ‘পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করিলে প্রত্যেক সন্তানকে সশরীরে উপস্থিত থেকে তাহাদের দাফন-কাফন বা সৎকারসহ পিতা-মাতার দায়দেনা পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো সন্তান প্রবাসজীবন বা অন্যকোনো কারণে পিতা-মাতার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সংবাদ পাইয়া উপস্থিত থাকিতে না পারিলে তাকে উপযুক্ত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যয়ভার বহনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হইবে।’

এছাড়া খসড়া এ বিধিমালায় বলা হয়, পিতা-মাতার ভরণপোষণে সবাইকে উৎসাহিত করতে উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য বার্ষিক সম্মাননা দেয়া। এজন্য একটি পৃথক আরেকটি নীতিমালার কথা উল্লেখ করা হয়।-বাংলা।