সুতিয়া নদীর তীর ঘেষা ত্রিশাল উপজেলা খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকের আলাপসিংহ পরগণার অন্তর্ভুক্তী, বিভিন্ন জমিদারদের শাসনকার্য, এবং মুক্তিযুদ্ধ সহ নানা ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দেশব্যাপী পরিচিত, পাশাপাশি এই উপজেলার বিভিন্ন কৃতি ও সফল ব্যক্তিত্বদের বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জনের সুবাধে ত্রিশাল এখন একটি পরিচিত জনপথ হয়েই জায়গা করে নিয়েছে সারাদেশে।
ত্রিশালের বুকে জন্ম নেওয়া বরণ্যে ব্যক্তিদের তালিকায় নজর বুলালে চোখে পড়বে একাধারে সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের কথা, ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলায় যার নাম আজীবন বাংলা সাহিত্যে লিখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে, সমাজের সমসাময়ীক বিষয়, বিভিন্ন অন্যায় প্রথা ও কর্মকান্ডের বিরুদ্ধ, জনগণ ও রাজনীতি সচেতনতা নিয়ে কলমের ভাষায় তিনি সহজেই সারাদেশে অর্জন করেছিলেন সুনাম, যার বদৌলতে আজো তিনি বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্র হয়ে বেচে আছেন সাহিত্যপ্রেমীদের মননে অন্তরে।
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার সবুজে ঘেরা ছায়া সুনিপুণ একটি গ্রাম ধানীখোলা, ১৮৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এই গ্রামের আবদুর রহিম ফরায়জী ও মীর জাহান বেগমের সংসারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে ব্যাঙ্গ সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত আবুল মুনসুর আহমদ, আর দশটা ছেলের মতই আবুল মনসুরের বেড়ে উঠা শুরু হয়, গায়ের মেঠোপথে দৌড়ঝাপ, পুকুরে সাতার কাটা, নদীতে মাছ শিকার কখনো বন্ধুদের সাথে হৈহোল্লা, ডাংগুলি, কাবাডি, বৌচি খেলেই কেটে যায় তার শৈশব, শিক্ষাজীবনের পথচলায় ১৯১৭ সালে তিনি নাসিরাবাদ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯১৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। এরপর তিনি ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা রিপন ল’ কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং বি.এল পাস করেন। এ বছরেই তিনি ময়মনসিংহে আইনব্যবসা শুরু করেন এবং সেখানে তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তাঁর পেশায় নিয়োজিত থাকে।
যার রক্তে তেজ, অন্যায়ে যার বিবেক জাগায় সে যেমন ফুলে ফেপে উঠে সহজেই তেমনি আবুল মনসুর আহমদের মাঝেও ভর করে সমাজ দেশ জাতী নিয়ে ভাবনা, অন্যায় প্রথা, নীতিক্ষয়, সহ সব বিষয় নিয়ে শুরু হয় তার চিন্তা, আইন ব্যাবসার পাশাপাশি তিনি শুরু করে সাংবাদিকতা, ক্রমান্বয়ে সাংবাদিকতায় তিনি হয়ে উঠে পেশাদার, তখন থেকেই তিনি কলমের হাল ধরেন সমাজ ব্যাবস্থার প্রতিচ্ছবি কে ফুটিয়ে তুলতে, সেই সময়েই সোলতান, মোহাম্মদী, দি মুসলমান, কৃষক, নবযুগ, ইত্তেহাদ, পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে তার একের পর এক লিখনি, সময়ের পরিক্রমায় তিনি ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দৈনিক কৃষক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন পরে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে চাকরি লাভ করেন, এ ছাড়া তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন, পাশাপাশি চলতে থাকে তার লেখালিখি।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি আবুল মনসুর বিচরণ শুরু করেন রাজনীতির চারণভূমিতে, খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, এরপর ১৮৭০ সালে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশ এর স্বরাজ্য পার্টির রাজনীতি সমর্থন করেন, এরপর ১৯২৯ সালে আবুল মনসুর বাংলার প্রজা পার্টিতে যোগ দেন এবং ময়মনসিংহ জেলায় দক্ষতার সঙ্গে কৃষক প্রজা সমিতি সংগঠনের কাজ করেন, সেই সময়েই তিনি ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৯ সালে আবুল মনসুর আহমদ আওয়ামী মুসলিম লীগ দল প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এছাড়াও তিনি যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচনী কর্মসূচি ২১-দফার অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
আবুল মনসুর আহমদ ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যদের ভোটে পাকিস্তান গণপরিষদ এর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৬-৫৭ সালে বণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। এরপর তিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আইনপেশা, সাংবাদিকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি তিনি লেখালেখিতে তিনি রাখেন তার সুনিপুণ ভূমিকা, বাংলা সাহিত্যে ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় কালজয়ী খ্যাতি অর্জনের অন্যতম সৃষ্টি আয়না ও ফুড কনফারেন্স এর মাধ্যমে তিনি সাহিত্য জগতে ব্যাপক সমাদৃত হন, এছাড়াও তার ব্যাঙ্গাত্মক সৃষ্টির অন্যতম হলো গালিভারের সফরনাম,তাঁর রচিত আরো উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, সত্যমিথ্যা, আবে হায়াত, হুজুর কেবলা, বাংলাদেশের কালচার, জীবন ক্ষুধা, ও আবে-হায়াৎ, এছাড়াও তিনি স্মৃতিকথা হিসেবে লিখেন আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর , শের-ই-বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি, পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পত্রিকা সাময়িকীতে লিখে চলেন কলাম ছোটগল্প, যা আজো প্রেরণা জোগায় বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও লেখকদের মাঝে।
পাঠকমহলে তিনি যতটা সুপরিচিতি লাভ করেন ঠিক ততটাই তার ভূমিকা নজরে আসে বিভিন্ন মহলের সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬০সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন, ১৯৭৯ সালে তাকে স্বাধীনতা দিবস পদক ও নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়।
আবুল মনসুর আহমদ তার সৃষ্টি কর্ম ও অনন্য এক জীবনের মাধ্যমে সারাদেশে যতটা পরিচিত হয়ে আছেন তার সাথে তেমনি পরিচিতি লাভ করেছে এই কালজয়ী ব্যক্তির জন্মস্থান ময়মনসিংহের ত্রিশাল, বলাবাহুল্য হয় উঠে এমন গুনী ব্যক্তিত্ব সারাদেশের মত ত্রিশালের গর্ব, যা ত্রিশালের জনগণের জন্য গর্বের এক অন্যতম এক কারণ। শুধু ত্রিশাল উপজেলাকে আলাদা করে পরিচয় করাতে না চাইলেও আবুল মনসুরের জন্য বৃহত্তর ময়মনসিংহ পরিচিত হয়ে উঠে এমন এক গুনীজনের জন্মস্থান হিসেবেই।
সাংবাদিকতা, আইনপেশা, রাজনীতি, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করা বাংলাভাষীদের এই অগ্রদূত ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ গন্তব্য বানিয়ে রওনা দেন না ফেরার দেশে।
শামিম ইশতিয়াক
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।