বিদ্রোহ, হুংকার, শব্দগুলো আসলেই উঠে আসে বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভার অধিকারী বিদ্রোহী কবি ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা, যার কলমে ছিল বিরত্ব, যার লেখনীতে ছিল সত্য ও ন্যায়ের ছন্দ, যা কিনা এখনো বাংলা সাহিত্যে বিচরণ করছে তার নিজস্বতা নিয়ে।
১১ই জৈষ্ট জাতীয় কবির ১২০তম জন্মদিন, জন্মদিনে জাতীয় কবির স্মৃতি রক্ষায় ও জাতীয় কবির প্রতি ভালোবাসায় ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় ভাবে প্রতিবছর পালন করা হয় নজরুল জন্ম জয়ন্তী, তাই আসুন আজ জেনে নেই বিদ্রোহী কবির স্মৃতি বিজরিত নজরুলময় ত্রিশালকে।
২৪ মে ১৮৯৯/১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন কাজী নজরুল ইসলাম,
জন্ম, বাড়ন্তকাল, আর শৈশব কবির জন্মস্থান বর্ধমানেই কেটেছিল, দারিদ্রতার করাঘাতে তখন এক রুটির দোকানে কাজ করত কিশোর নজরুল যখন ছিল ১৯১৪ সাল, ততকালীন সময়ে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সন্তান কাজী রফিজউল্লাহ সাহেব পুলিশে চাকরি করতেন ভারতের বর্ধমানে তখন দুখুমিয়া ওই রুটির দোকানে কাজ করত আর রাতে দারোগা সাহেবের বাসার বারান্দায় ঘুমাতে আসত। তাঁর চোখে-মুখে তখনই সুপ্ত প্রতিভার ছাপ দেখে রফিজউল্লাহ দারোগা সেই কিশোরকে নিয়ে এসেছিলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের নিজের গ্রামের বাড়ি কাজির সিমলাতে, নজরুলকে তখন রফিজউল্লাহ দারোগা তাঁর নিজ বাড়ি থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরে তখনকার নবপ্রতিষ্ঠিত নামকরা দরিরামপুর ইংলিশ হাই স্কুলে (বর্তমানে নজরুল একাডেমি) ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কাজির সিমলা থেকে দরিরামপুর স্কুল দূরে হওয়ায় কাছাকাছি হিসেবে বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে জায়গির ঠিক করে দেন দারোগা সাহেব। যেই বাড়িটিই বর্তমানে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র।
এই বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়ি থেকে ত্রিশাল বাজারে যাওয়ার রাস্তায় শুকনির বিলের পাড়ে ছিল এক বটগাছ, তখনকার সময়ে কবি এই বটতলায় এসে সমবয়সী ও সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে বাঁশি বাজাতেন। বর্তমানে এই শুকনি বিলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবির নামে ত্রিশালবাসীর ভালোবাসা ও গর্বের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মাঝে প্রথম যে অঞ্চলে নজরুল আসেন তা হলো ত্রিশাল, তাই ত্রিশালের মানুষ কবি নজরুলকে গর্বের সাথে ধারণ করে আছেন, এখানে কবির নামানুসারে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, প্রতিবছর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম জয়ন্তী রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্রিশালে উদযাপন করা হয়, ত্রিশালের সংস্কৃতিতে তাই জাতীয় কবির প্রভাব ব্যাপক, বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংগঠন ত্রিশালের সংস্কৃতিতে নজরুল ও তার সাহিত্যকে অবলম্বন করে অবদান রেখে চলেছে।
ত্রিশালে কবির স্মৃতিবিজরিত স্থান বা স্থাপনার মাঝে অন্যতম হলো কবি নজরুল জাদুঘর, কবি যে ঘরটিতে থাকতেন সেই কুঁড়ে ঘরটি আজ আর নেই কিন্তু সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই স্থানটিতে কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে। এছাড়া এখানে কবির স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি যাদুঘর, লাইব্রেরী এবং অডিটরিয়াম নির্মান করা হয়েছে। যাদুঘরে কবির স্বহস্তে লিখিত বেশ কিছু দুর্লভ পান্ডুলিপি,কবির ব্যবহৃত কিছু দুস্প্রাপ্য সামগ্রী এবং কবির কর্মময় জীবনের বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র সরক্ষিত রয়েছে, এই স্থানটি শুধুমাত্র নজরুল গবেষক-ই নয় সাধারণ মানুষের জন্য ও একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে, দেশ বিদেশের খ্যাতিমান নজরুল গবেষক,শিল্পীগণ এবং তদুপরি দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ এই কেন্দ্রটি ভ্রমনে এসে বেশ কিছু গাছের চারা রোপন করেছেন প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থীর এখানে আগমন ঘটে।
এছাড়াও কবির বাশি বাজানোর সেই বটগাছের পাশেই ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবির স্মৃতি স্মরণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যালয়টি ত্রিশালবাসীর নজরুল প্রেম ও নজরুলের স্মৃতিরক্ষায় ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দাবীর ফসল, ২০একর আয়তন বিশিষ্ট এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ সালের ৩ জুন ১৮৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমের সূচণা হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ এবং ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৫টি বিভাগ রয়েছে, এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় এর একাডেমি কার্যক্রম সম্প্রসারণে এখনো কাজ চলছে।
এছাড়াও নজরুলের প্রথম আসা কাজী রফিজউল্লাহর গ্রামের বাড়ি কাজির শিমলাতে আছে নজরুল জাদুঘর, এবং নজরুলের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কাজির শিমলা নজরুল উচ্চ বিদ্যালয়।
এছাড়াও ত্রিশালে রয়েছে নজরুল ডাকবাংলো, যেখানে বিদেশী অনেক নাগরিকরা অবস্থান করে। রয়েছে নজরুলের অধ্যায়ন করা বিদ্যাপিঠ দরিরামপুর হাই স্কুল, যাকে কিনা বর্তমানে নজরুল একাডেমি নামে রুপান্তরিত করা হয়েছে। বর্তমানে এই নজরুল একাডেমির মাঠে প্রতিবছর নজরুল জন্ম জয়ন্তীতে এক মেলার আয়োজন করা হয় যাতে দেশের সকল প্রান্ত হতে অনেক ব্যাবসায়ী অংশগ্রহণ করে এবং এখানে পাওয়া যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্য সহ দূর্লভ অনেক পণ্য, এই মেলা তিনদিন থাকে আর এই তিনদিন যেনো ত্রিশালে বিরাজ করে আনন্দঘন এক উৎসব।
এছাড়াও আছে নজরুল মঞ্চ যেখানে প্রতি বছর নজরুল জয়ন্তী পালন করা হয় এবং দেশের বিখ্যাত, প্রখ্যাত ব্যাক্তিরা এখানে আসেন, আসেন অনেক শিল্পি ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিবর্গ। এছাড়াও ত্রিশালে নজরুল কলেজ নামে রয়েছে একটি সরকারি কলেজ।
ঢাকা শহর হতে ১০০কিমি দূরত্বে এবং ময়মনসিংহ শহর হতে ২২ কিমি দুরত্বে অবস্থিত এই ত্রিশাল উপজেলা,
বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত হতে ত্রিশাল দরিরামপুর বাস স্ট্যান্ড এসে নামলেই আপনি যেনো হারিয়ে যাবেন নজরুলময় এক ত্রিশালের বুকে।
লেখকঃ শামিম ইশতিয়াক
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।