তিন সপ্তাহ ধরে চলা ধারাবাহিক অগ্নিকান্ডে কারণে হুমকির মুখে আমজনের অস্তিত্ব।ইতিমধ্যে দেশটির ১৮ লাখ একর বা সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু ব্রাজিল নয়, এখন বলিভিয়া এবং পেরুর অংশেও জ্বলছে আগুন। পৃথিবীর ফুসফুস আজ বিপন্ন। আগুনের লেলিহান ক্রমশ গ্রাস করছে চিরহরিৎ আমাজন বনাঞ্চল। বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র।
আমাজন জঙ্গলে আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্রাজিল সরকারের অদূরদর্শী কর্মকা- ও দেশটির প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর পদত্যাগের দাবিতে গত ২৩ আগষ্ট বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ব্রাজিল দূতাবাসের
সামনে বিক্ষোভ করেছেন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা প্যারিস, লন্ডন, মাদ্রিদ, বোগাতো, টরেন্টোসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ব্রাজিল দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করেন। এসব বিক্ষোভ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোকে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য উচ্চারণ করা হয় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান।ব্যাপক সমালোচনার মুখে সম্প্রতি আমাজনে সেনা মোতায়েনসহ সামরিক বিমান থেকে পানি ছিটানোর কাজ শুরু করেছে দেশটির সরকার। সেনাবাহিনীর প্রায় ৪৪ হাজার সদস্যকে নিয়োগ করা হয়েছে আগুন নেভানোর কাজে।
বিক্ষোভকারীদের মতে, আমাজনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার সরকারি নীতির কারণেই আগুন লাগানোর মতো মহোৎসব শুরু হয়েছে। আমাজনে আগুন লাগানোর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই পড়ে যায়। বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে চিত্রতারকারাও আগুন নিয়ে ব্রাজিল সরকারে বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে। সমালোচনার ঝড়ে কেঁপে উঠে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যম। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ব্রাজিল দূতাবাসের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে শত শত পরিবেশবাদী। ‘ইয়োথ ফর ক্লাইমেট’ নামের একটি গ্রুপ এ বিক্ষোভের আয়োজন করে। ‘আমাজানের জন্য প্রার্থনা’ ‘আমজন বাঁচুক’ ‘বলসোনারো মরে যাও’ ‘বন ছাড়া আমরা ধ্বংস হবো’ সহ নানা ধরনের স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। অনেক বিক্ষোভকারী রক্তের আদলে রং মেখে বিক্ষোভে অংশ নেন। সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরেও একই ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।
ইতিপূর্বে আমজনের সুরক্ষাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন বলসোনারো। ব্রাজিল মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের স্পেস রিসার্স বলছে, চলতি বছর জুন পর্যন্ত ব্রাজিলে ৭২ হাজার ৮৩৪ টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে আমাজন জঙ্গলে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩-এর তুলনায় দ্বিগুণ। আমাজনের আগুনের ধোঁয়ার বলি হচ্ছে আশপাশের শহরগুলো। আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলোসহ বেশ কয়েকটি শহর দিনের বেলায় অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই চিরহরিৎ বনের ৬০ শতাংশ পড়েছে ব্রাজিলের অংশে। এছাড়া বলিভিয়া, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও ভেনিজুয়েলাসহ আটটি দেশেরও রয়েছে এই বনাঞ্চলের বিস্তার। চলমান দাবানলে প্রতিমিনিটে আমাজনের প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা পুড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ফুসফুস বলে খ্যাত এই বনাঞ্চল এভাবে পুড়তে থাকলে একে আর বাঁচনো যাবে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ২০৫০ সালের মধ্যেই বনাঞ্চলটি হয়তো একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমাজন নদী অববাহিকায় ৯ টি দেশের ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটারে বিস্তৃত এ বনাঞ্চল থেকে পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। প্রতি বছর ২০০ কোটি মেট্রিকটন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এই বন। এ কারণে একে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। প্রায় ৪০০-এর বেশি গোত্রের আদিবাসীর বসবাস এই বনে। এছাড়া এখানে প্রায় ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯ হাজার কোটি বৃক্ষ, ৪৫ হাজার প্রজাতির পোকা-মাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো বনে এতবেশি প্রাণী ও জীববৈচিত্র নেই।
আমজনে আগুন নেভাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে সহযোগিতার হাত বাড়াতে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পুনর্বাসনের জন্য ১ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে আমাজনে আগুন নেভানোর ব্যাপারে জি-৭ সম্মেলন থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৭ দেশের নেতারা। আগুন নেভাতে দেশগুলো ২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করবে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া পুনর্বাসনের সাহায্য করার প্রতিশ্রতিও দিয়েছেন নেতারা। জি-৭ জোটের সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, কারিগরি ও আর্থিক সহাযোগিতা দিতে আমাজন অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে তার সরকার। এদিকে বলসোনারো এক টুইটে বলছেন, আমাজন রক্ষায় আন্তর্জাতিক জোট গঠনের যে ধারণা চলছে, তা তার দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর একটি আঘাত। তিনি আরো বলেন, এই জোট গঠিত হলে ব্রাজিলের সঙ্গে ‘ উপনিবেশ কিংবা মনুষ্যহীন ভূখ-ের’ মতো আচরণ করা হবে। ওই টুইটে আমাজন রক্ষায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আন্তর্জাতিক কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি।
চলতি মাসের ১৫ তারিখ থেকে জ্বলছে ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চল। এর মধ্যে গত কয়েক দিনের মধ্যে আমাজনের এক হাজার ২০০ টি স্থানে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন করে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের শরণাপন্ন হয়েছে ছয়টি রাজ্য। বিভিন্ন স্তানে ভয়াবহ রকমের আগুনের কু-লী তৈরি হয়েছে। এসব রাজ্যের কর্তৃপক্ষ আগুন নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনীর সহায়তা চেয়েছে। সেনা সহায়তা চাওয়া রাজ্যগুলি হলো- পারা, রন্ডোনিয়া ,রোরাইমা, টোকানটিন্স, একর এবং ম্যাটো গ্রোসো। এর মধ্যে রন্ডোনিয়া প্রদেশে ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনীর বিমান থেকে পানি ঢালার কাজ শুরু হয়েছে। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্স জানিয়েছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ৭৪ হাজার দফায় অগ্নিকা-ের শিকার হয়েছে এ বনভূমি। তবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের আগুন ভয়াবহ। আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থি ও বাণিজ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোর নীতিকে দায়ী করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বন পুড়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণের নীতির জন্য নিজ দেশের পরিবেশবাদীদের তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। সর্বশেষ আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্রাজির সরকারের নিষ্ক্রিয়তার ঘটনায় দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্রাজিলিয়ান অর্থনীতিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে অন্য দেশগুলো। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আমাজনের আগুন নেভাতে উদ্যোগী হয় বলসোনারো সরকার। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফার্নান্দো আজেভেদো বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তার কথা বললেও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। এক ফোনালাপে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারোকে ওই সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এরপর এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে নীরব থাকলেও আমাজন বনাঞ্চলকে বাঁচাতে সবার আগে বিমান থেকে পানি ঢালার উদ্যোগ নেয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। আগুন নিয়ন্ত্রণে সুপারট্যাংকার বোয়িং বিমান ৭৪৭-৪০০ ভাড়া করার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। গত ২৩ আগষ্ট থেকেই আকাশপথে ওই সুপারট্যাংকার নিয়ে অভিযান শুরু করেছে বলিভিয়া।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দুনিয়ার ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয়া আমাজনের ভয়াবহ এ আগুন আদতে কোনো দুর্ঘটনা নয়। সেখানে যে আগুন জ্বলছে তার বেশির ভাগই লাগাচ্ছে কাঠুরে ও পশুপালকেরা। গবাদি পশুর চারণভূমি পরিস্কার করতেই এসব আগুন লাগানো হচ্ছে। আর এতে উৎসাহ যোগাচ্ছেন ট্রাম্পপন্থী হিসেবে পরিচিত দেশটির উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো। তিনি ব্রাজিলেল ট্রাম্প হিসেবেও পরিচিত। আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমাজনে আগুন লাগানোর ঘটনায় ব্রাজিল সরকারে নিষ্ক্রিতায় দেশটি থেকে গরুর মাংস আমদানি নিষিদ্ধের বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ফিনল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ব্রাজিল থেকে গুরুর মাংস আমদানি নিষিদ্ধ করার কথা দ্রুত ভাবার আহবান জানান। অন্যদিকে ব্রাজিলের এই শিল্প সম্প্রসারণে গত জুনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যাতে কার্যকর না হয় সে বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার ঘোষণা দেয় ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ড।
আমাজন বনাঞ্চলে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে জি-৭ দেশগুলো যে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে বলে জানিয়েছে ব্রাজিল সরকার। জি-৭ সম্মেলনের শেষ দিনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আমাজনের দাবানল নিয়ন্ত্রণে জি-৭ দেশগুলো ২ কোটি ২০ লাখ ডলার দিতে রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এই অর্থ সাহায্য প্রস্তাব প্রত্যাখানের কোনো কারণ উল্লেখ করেননি ব্রাজিলের কর্মকর্তারা। তবে তাদের মতে ফ্রান্স তাদের সাথে উপনিবেশের মতো আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো। ব্রাজিল সরকারের অভিমত হলো- জি-৭ ঘোষিত অর্থ সম্পদগুলো ইউরোপের বনায়ন কাজে লাগানোই বেশি প্রাসঙ্গিক হবে এখন।
স্থাানীয় বনকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় ব্রাজিল তা যে কোনো দেশকে শেখাতে পারবে।ব্রাজিল সরকারে এধরনের দম্ভোক্তির পেছনে কোন দূরভিসন্ধি কাজ করছে তা বলা মুশকিল। ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থী পরিবেশবিনাশী সরকার মুখে যাই বলুক না কেন, আমাজন শুধু ব্রাজিলের নয়, এটা সারা বিশ্ববাসীর সম্পদ। এর সাথে পৃথিবীর নয়শ’কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িত। জড়িত জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব, জীববৈচিত্র , বাস্তুসংস্থান ও উষ্ণায়নের বিষয়গুলোও। তাই আমাজনের আগুন দ্রুত নেভানোর কাজে পৃথিবীর প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলিকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।কারণ ব্রাজিলের একার পক্ষে আমাজনের এই ভয়াবহ আগুন নেভানোর সম্ভব নয় এবং দেশটির সেই সক্ষমতাও নেই। নেই আধুনিক প্রযুক্তি ও যুতসই কলাকৌশল। দেশটির গত তিন সপ্তহের কার্যক্রম থেকেই বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাই পৃথিবীর ফুসফুসকে যেকোনো মূল্যেই বাঁচাতে হবে। ফুসফুস ছাড়া মানুষ যেমন বাঁচতে পারে না, তেমনি বাঁচতে পারে না পৃথিবী তার উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল্। বাঁচতে পারে না পরিবেশ ও জীববৈচিত্র।পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই আমাজন বনাঞ্চলে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমাজনের আগুন নেভাতে তাই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
নিতাই চন্দ্র রায়
কৃষিবিদ ও কলাম লেখক