ক্ষমতাধরদের মারে দুই পা হারিয়ে কাঁতরাচ্ছেন জামালপুরের সাংবাদিক শেলু আকন্দ। ময়মনসিংহে ডিবি পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য, দুর্নীতি অনিয়ম নিয়ে দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিনে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেন পত্রিকাটির সম্পাদক খায়রুল আলম রফিক। পরে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সাংবাদিক খায়রুল আলম রফিক কে ধরে নিয়ে ডিবি পুলিশ অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং পরবর্তীতে সাজানো একটি আইসিটি মামলায় চালান করেন।
হেনস্তার শিকার হয়ে গ্রেফতারের পর ছাড়া পেয়েছেন সাংবাদিক কিবরিয়া এবং পান্নু। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় খুলনায় হাতকড়া পরিয়ে তুলে নেয়া হয় একাত্তর টিভির সাংবাদিক রকিব উদ্দিন পান্নুকে। আর ঢাকায় অফিসে কর্মরত অবস্থা থেকে ঘাড় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দৈনিক জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার সম্পাদক কিবরিয়া চৌধুরীকে।
সাংবাদিকদের এভাবে অপদস্ত-তাচ্ছিল্য করা আচমকা বা নতুন ঘটনা নয়। কেউ কেউ বলতে চান- হাতে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি নিয়েই দুনিয়াতে সাংবাদিকতা-তথা সাংবাদিকতার অভিষেক। এটা না-কি পেশাটির বৈশিষ্ট্যের মতো। কিন্তু, কেন? কোন দুঃখে, কোন পাপে এ তাপ? খুলনা ওয়াসার কাজে গাফিলতির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথমে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বেদম মার খান পান্নু। পরে তারা পুলিশ ডেকে আনেন। পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যায় তাকে। আর কিবরিয়াকে ছো মেরে তুলে নেয়া হয় তার মতিঝিল কর্মস্থল থেকে। নোয়াখালীর সোনাপুর থানা থেকে ঢাকা এসে মতিঝিল থানার সহায়তায় এ কর্মযজ্ঞ সাঙ্গ করে পুলিশ।
কাজের কী গতি এবং বেগ পুলিশের! এর বিপরীতে সাংবাদিক সমাজ থেকে কড়া কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি কিছু পোর্টাল ও ফেসবুকে মিউ মিউ টাইপে ইসফিস করা ছাড়া। সাংবাদিকদের বেশুমার সংগঠন থেকে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কারো কারো আক্ষেপ চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ক্যাসিনোবাজদের গ্রেফতারে পুলিশ সম্মান দেখালেও ক্ষমতাসীন ঘরানার দাপটশালী একাত্তর টিভির পান্নু বা সরকারের খাস সাংবাদিক কিবরিয়াকে এর ছিটাফোঁটাও করলো না পুলিশ। উল্টোদিকে, মজা বোধের কিছু কায়কারবারও দেখা গেছে। প্রতিপক্ষ সাংবাদিক মহল বিকৃত তৃপ্তি পেয়েছে। সরকারের অতিশয় আজ্ঞাবহদের এমন ছ্যাচা তাদের কাছে আনন্দদায়ক ঘটনা। যারা আদর-সোহাগ করে আসছেন, তারাই একটু শাসন করেছেন, উচিৎ কাজ হয়েছে, মজা বুঝুক-তাদের এমন ভাবটা লুকানো থাকেনি।
সাংবাদিকদের এমন রহস্যজনক ‘গুডবয়’ ভূমিকা তাদের সহকর্মী সাগর-রুনি হত্যা মামলার চার্জশিট ৭০ বার পেছালেও। এটাই দেশের সাংবাদিক সম্প্রদায়ের বর্তমান হাল। সেখান থেকে চেতিয়ে চেতনা আনার অবস্থা হারিয়ে গেছে। সেই চেষ্টা করাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ লোহার খাঁচায় ঘুমিয়ে থাকা বন্দির খাঁচা ভাংগার শক্তি থাকে না। এ দশায় তাদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টা কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেবে কি-না, সেই সংশয়ও থেকে যায়। দু’চার দিনে এ দশায় এসেছে গণমাধ্যম জগত? অথবা একে ভাগ্যের লিখন বলে চেপে চাওয়া যায়? কেন সাংবাদিকদের মেরুদণ্ডের এ ব্যাকপেইন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে- এ প্রশ্নের এক কথায় জবাব মেলা কঠিন। কিবরিয়া চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে। এই আইনটি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। সব সাংবাদিক এর নীতিগত প্রতিবাদ করেননি। পরে অজ্ঞাত কারণে সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে আর কথাও বলেননি। সম্রাট গ্রেফতার পরবর্তী সময় সাংবাদিকদের কে কে সম্রাটের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি হচ্ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি তাদের শিক্ষা দিয়ে ছাড়া হয়েছে তাদের কয়েকজনকে।
সাংবাদিকদের দলবাজি, মোশাহেবি, তোষামোদি, তেলবাজিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তার বিরক্তির কথা জানিয়েছিলেন প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে। লজ্জা দিয়েছেন। এরপরও তারা দমেননি। দমছেন না। তাদের এ ভূমিকায় দলীয় তস্কররাও মনোকষ্ট পায়। ক্ষেপে সাংবাদিক নামের জীবদের ওপর। কারণ যে কাজটি করে দলবাজ নেতাকর্মীরা স্নেহে পিচ্ছিল হয় সেটি কেন অন্যরা করবে- এ কষ্ট তাদের ভোগায়। পীড়া দেয়। হিংসা জাগায়। প্রাপ্তির উম্মাদনা আর বোকামি যেটাই হোক সাংবাদিকদের একটি অংশ বুঝতে নারাজ ক্ষমতাধরদের কখনো তেলের ক্রাইসিস হয় না। তেলামাথায় তেল ভূতেও জোগায়। মালিশ-পালিশে ঘাটতি পড়ে না ক্ষমতার শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত। হোক না জ্বী-হুজুরদের হুজরতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আমন্ত্রিতও। সাংবাদিকরা কেন ভিড়বেন সেই পালে? দলবাজির রঙে কেন হবেন দুঃস্থ-অসুস্থ?
হতে পারে অল্পতে বেশি লাভ বা শটকাটে বিশাল প্রাপ্তির লোভ সামলানো কঠিন। জায়গা মতো তৈলমর্দন বহু সুবিধা এনে দেয়। রাজনীতি, সমাজ, সর্বত্র তাই তৈলমর্দন খুউব উপাদেয়। এরপরওতো কথা থাকে। সাংবাদিকতা অন্যসব পেশার চেয়ে একটু আলাদা। তারাতো জাতির বিবেক, রাষ্ট্রের চার নম্বর খাম্বার স্থপতি। ভাবের সঙ্গে ভঙ্গির কমতি না থাকলেও সাংবাদিকরা একটি কমজুরি সম্প্রদায়। এই নিরীহ শ্রেণিটিকে নিয়ে গালমন্দ করা যায় অবাধে। সাংবাদিকদের সম্পর্ক যে কেউ যে কোনো মন্তব্য করতে পারেন। মন চাইলে মারও দিতে পারেন। শক্ত কোনো প্রতিবাদ হয় না। দরকার পড়লে তারা সাংবাদিকদের তোয়াজ করেন। কাজে খাটাতে না পারলে করেন গোষ্ঠী উদ্ধার। সাংবাদিকদের গণায় ধরা বা আমল দেয়ার দরকার মনে করেন না মাননীয় মহাশয়রা। শুধু নিজেদের প্রচার ও কাভারেজের জন্য মাঝেমধ্যে সাংবাদিকদের সম্মানের ডগায় একটু-আধটু চুলকানি দেন তারা। সেটা মোটেই কদর দেয়া নয়।
কেন এই দশা হলো আমাদের? আশপাশে, কাছে কিনারে কেন এমন নিপাতনে সিদ্ধ হচ্ছি আমরা! এরপরও কেন গায়ে পানি লাগে না সাংবাদিকদের? রাজধানীতে বাড়িভাড়া বা আত্মীয়তার প্রার্থিতাসহ সামাজিক জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কী অবস্থা-অবস্থান আমাদের? এই হাল নমুনায়ও কি কোনো বোধবুদ্ধি আসতে নেই? অথচ পেশা হিসেবে অত্যন্ত সম্মানজনক ও চ্যালেঞ্জিং পেশাটির মানুষদেরতো তা হবার কথা নয়। সাংবাদিকরা মেধা-শ্রম নির্ভর এ পেশাজীবীরা চ্যালেঞ্জটি জয় করেন অভিজ্ঞতা, বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে। অন্য পেশায় তা এতো চোখা নয়। তারা আগে থেকেই জানেন আজ তার কী কাজ করতে হবে। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রতিদিনই মোকাবেলা করতে হয় নতুন কাজ। কিন্তু মর্যাদার প্রশ্নে তারা কেন এতা বোধহীন, বোহিমিয়ান? কিছু তস্কর, আতিপাতি গোটা পেশাটার এই দুর্গতির কারণ হয়ে থাকলে এখন শুদ্ধ হতে বাধা কোথায়?
লিল্লাহ বোর্ডিং সম্মানের নয়। অবহেলা, দোষারোপ সইতে সইতে প্রান্তিকতায় ডুবে অপদস্থ হওয়া মরনের নামান্তর। মোসাহেবিতে দুঃস্থ-অসুস্থ, অসহায়-অথর্ব থাকার চেয়ে মৃত্যু গৌরবের। দুস্থ-অসুস্থদের পক্ষে সক্ষম-সামর্থবান হওয়া অসম্ভব। এর পরই না জাতির বিবেক হওয়া। সাংবাদিকতা বাংলাদেশেও এখন একটি পরিপূর্ণ পেশা। মোটেই শখ মেটানোর ব্যাপার নয়। স্বেচ্ছাশ্রমে খাটার দিনও শেষ। লক্ষ্য-অঙ্গীকারের পাশাপাশি রুটি-রুজি, কর্মসংস্থানের বিশাল ক্ষেত্র।
এক সময় দেশে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ দেওয়া হতো শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তা-ও ডিপ্লোমা এবং নাইট কোর্স। সেটি এখন আর ডিপ্লোমা বা কোর্সের মধ্যে নেই। রাতের ক্লাস এসেছে দিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের নাম পাল্টে হয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় সাবজেক্ট। প্রতিবছর প্রাইভেট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। জেনে-বুঝে-শুনে জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে প্রতিবছর সাংবাদিকতা ছাড়াও গণমাধ্যমে বিভিন্ন পদে অভিষেক ঘটছে শত শত তরুণ-যুবকের। কেবল সংবাদপত্রই এখন তাদের কর্মক্ষেত্র নয়। দুই ডজনের বেশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন, বেশ কটি এফএম রেডিও ছাড়াও রয়েছে নতুন নতুন অনলাইন মাধ্যম। সময়ের চাহিদা ও দ্রুত উৎকর্ষের সুবাদে সাংবাদিকতার ধরন-ধারা-ধারণা পাল্টে এসেছে অনেক আপডেট। কিন্তু, পেশাটিতে কর্মরতরা পেশাদারিত্বে কদ্দুর আপডেট হচ্ছি?-সেই প্রশ্ন আজ তোলাই থাক।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট ; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।