হিজাজকে ‘সৌদি আরবে’ রূপান্তর ও ইসরাইল গঠনে ইবনে সৌদের ভূমিকা

৯৩ বছর আগের কথা। ১৯২৬ সালের ৮ জানুয়ারি নজদ্‌ অঞ্চলের একটি ওয়াহাবি গোত্রের প্রধান আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ নিজেকে হেজাজের রাজা বলে ঘোষণা করেন।

মক্কা ও মদিনার পবিত্র মাজারগুলো ধ্বংস করা এবং জেদ্দাহ ও তায়েফ- এমনকি  পবিত্র মক্কা ও মদিনা শহরের মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানোর পর নিজেকে রাজা বলে দাবি করে ইবনে সৌদ। এইসব শহরে পৃথকভাবে অন্তত বিশ হাজারেরও বেশি মুসলমানকে শহীদ করেছিল ইবনে সৌদের তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী সেনারা।

ইবনে সৌদ ছিল আরব বিশ্বে ওসমানি খেলাফতকে বিপর্যস্ত করার কাজে নিয়োজিত ব্রিটেনের বেতনভোগী অনুচর। ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে তাকে অর্থ দিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। বিংশ শতকের তথা গত শতকের বিশের দশকে ব্রিটেনের আরেক অনুচর হেজাজের শাসক শরিফ হুসাইনকে ব্রিটিশরাই সরিয়ে দেয় ইবনে সৌদকে ব্যবহার করে। ফলে ইবনে সৌদের রাজ্যের সীমা হেজাজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। রক্তপাত, গণহত্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে ইবনে সৌদ দখল করেছিল হিজাজ। ইবনে সৌদ দখল করে ইয়েমেনেরও এক বিশাল অংশ এবং  আরব উপদ্বীপের পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত তেল-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোও দখল করতে সক্ষম হয়।

১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের অনুচর ও সেবাদাস আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ব্রিটেনের অনুমতি নিয়ে হিজাজের নাম পরিবর্তন করে নিজ বংশের নাম অনুযায়ী এই বিশাল আরব ভূখণ্ডের নাম রাখে সৌদি আরব। এই দেশই (বর্তমান সৌদি আরব) বিশ্বের একমাত্র দেশ যার নামকরণ করা হয়েছে দেশটির সংখ্যালঘু একটি গোত্রের নাম অনুসারে।

আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ছিল ‘নজদ্‌’ নামক মরু অঞ্চলের অধিবাসী। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সে ওয়াহাবি  সম্প্রদায়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উগ্র মতবাদটির জন্ম দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।

ব্রিটিশরা ওসমানি খেলাফত তথা অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ইবনে সৌদকে অনুচর হিসেবে বেছে নেয় এবং এ জন্য তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করে।

তুরস্ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হলে ইবনে সৌদের সাহস বেড়ে যায়। ফলে সে আরব অঞ্চলের নানা অংশে সেনা অভিযান চালাতে থাকে। ক্ষমতাসীন আলে-রশিদ গোত্রকে পরাজিত করার পর সৌদের বাহিনী ১৯২৫ সালে হিজাজে অভিযান চালায়। হিজাজের পবিত্র মক্কা ও মদীনা শহরসহ বন্দর শহর জেদ্দাহ, তায়েফ ও ইয়ানবু শহরে সৌদের বাহিনী  অন্ততঃ বিশ-ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছিল।

মক্কা ও মদীনার পবিত্র মাজারগুলোর অবমাননা ও ধ্বংস সাধন ছিল সৌদের জঘন্য হঠকারিতার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য। মহানবীর (সা) আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম জাইনুল আবেদিন, হযরত ইমাম বাকির ও হযরত ইমাম জাফর সাদিকের (তাঁদের সবার ওপর দরুদ ও সালাম) পবিত্র মাজারও ছিল এসব মাজারের মধ্যে। সৌদের বাহিনী ইয়েমেনের জাইদি শিয়া ইমামের শাসনাধীন নাজরান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চল দখল করে। এর আগে তার বাহিনী আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের শিয়া মুসলিম শেখ-শাসিত তেল-সমৃদ্ধ কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যও দখল করেছিল।

এরপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আরেক অনুচর হিজাজের শরিফ হুসাইনকে পুরস্কার দেয়ার জন্য তার দুই পুত্র ফয়সল ও আবদুল্লাহকে যথাক্রমে ইরাক এবং নব-গঠিত জর্দান নামক দেশের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ অবস্থায় ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে রাজার উপাধি ব্যবহারের অনুমতি দেয় এবং তার দখল-করা অঞ্চলকে ‘সৌদি আরব’ হিসেবে ঘোষণা করারও অনুমতি দেয়। অবশ্য এইসব অনুমতি ব্রিটিশরা তখনই দেয় যখন ইবনে সৌদ এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার কোনো বিরোধিতা করবে না।

১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণা ব্যালফোর ঘোষণা নামে ইতিহাসে খ্যাত। এ ঘোষণা দেয়ার আগে ব্রিটিশরা সৌদি রাজা আবদুল আজিজের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র আদায় করেছিল। ওই চিঠিতে লেখা ছিল:

ফিলিস্তিনে ইসরাইল গঠন করতে দিতে ব্রিটেনের প্রতি সৌদি রাজা আবদুল আজিজের সম্মতি-পত্র 

 

“আমি বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুর রহমান–ফয়সলের বংশধর ও সৌদের বংশধর– হাজার বার স্বীকার করছি ও জেনেশুনে বলছি যে, মহান ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি স্যার কুকাস-এর সামনে  স্বীকারোক্তি করছি এই মর্মে যে, গরিব ইহুদিদেরকে বা অন্য কাউকে ব্রিটিশ সরকার যদি ‘ফিলিস্তিন’ দান করে দেন তাহলে এতে আমার কোনো ধরনের আপত্তি নেই। বস্তুত: আমি কিয়ামত পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের অভিমতের বাইরে যাব না।” (নাসিরুস সাইদ প্রণীত ‘আলে সৌদের ইতিহাস’ )

একবার (১৯৪৫ সালে) বাদশাহ আবদুল আজিজ সৌদ ইহুদিবাদী ইসরাইল গঠনের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বসে। সঙ্গে সঙ্গে বা ততক্ষণাত ব্রিটিশ সরকার ও ইহুদিবাদীদের পক্ষে দু’জন প্রতিনিধি এসে বাদশাহ আবদুল আজিজের সঙ্গে দেখা করে এবং বাদশাহকে তার সম্পাদিত সম্মতি-পত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন বাদশাহ তাদের বলেছিল:

“ আমি ইহুদিদের স্বার্থে কার্যত যা করে যাব তার ওপর বিশ্বাস রাখবেন। কি বলছি তার দিকে লক্ষ্য করবেন না। কারণ, এ ধরনের কথা না বললে আমি (ক্ষমতায়) টিকে থাকতে পারব না।”  বাদশাহর এই কথা শুনে ব্রিটিশ সরকারের ও ইহুদিবাদীদের প্রতিনিধি খুশি হয়ে ফিরে যায়। (নাসিরুস সাইদ লিখিত ‘আলে সৌদের ইতিহাস’, পৃ-৯৫৩)

১৯১৪ সালে স্বাক্ষরিত আল-আকির চুক্তি অনুযায়ী ইবনে সৌদ তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। আর বাহরাইন ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্বে থাকবে বলেও সৌদ কথা দেয় এবং উপসাগরীয় এলাকায় ব্রিটিশ নাগরিক ও ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলেও ওই চুক্তিতে অঙ্গীকার করে। বিনিময়ে ব্রিটিশ সরকার ইবনে সৌদকে সমর্থন দেয়ার ও যে কোনো পক্ষ থেকে তার ওপর আক্রমণ করা হলে তা প্রতিহত করবে বলে ওয়াদা দেয়। (‘সরওয়াতুস সৌদিয়া’, পৃ-৩৯ এবং ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’, পৃ-২০)

এভাবে সে যুগে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ও শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচিত তুর্কি খেলাফতের ধ্বংস সাধনে সৌদি রাজা আবদুল আজিজ ও ব্রিটেনের যৌথ ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়িত হয়েছিল। সৌদের অনুগত ওয়াহাবি সেনারা তুর্কি মুসলমানদের গুলি করে হত্যা করেছিল এবং রক্ষা করেছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের ও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে। তাই এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব নামক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ইসলাম রাজতন্ত্র সমর্থন করে না বলে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন।

উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটেন সৌদিদেরকে তথা সৌদি বংশের লোকদের ব্যবহার করে। ফলে তুর্কি সরকার ওয়াহাবিদের রাজধানী ‘দারইয়া’ শহরটি দখল করে নেয়। আর সৌদি সর্দার আমির আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করে প্রথমে কায়রোতে ও পরে তুরস্কে পাঠিয়ে দেন মিশরের শাসক মুহাম্মাদ আলী পাশা। তুর্কি খেলাফতের সরকার আমির আবদুল্লাহকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে।

কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের অবস্থা দুর্বল হয়ে গেলে ব্রিটিশরা আবারও সৌদ গোত্রের লোকদের নিয়ে ষড়যন্ত্র  শুরু করে। ব্রিটেন ইবনে সৌদের সঙ্গে কুখ্যাত ‘দারান’ চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৫ সালে। কুয়েতের শেখ জাবির আল সাবাহ ছিল সে সময় ব্রিটিশদের আরেক দালাল। ব্রিটিশরা এই দালালের মাধ্যমে ইবনে সৌদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার সৌদ-পরিবারকে প্রতি বছর ষাট হাজার পাউন্ড ভাতা দিতে থাকে। পরে এ ভাতা বাড়িয়ে এক লাখ পাউন্ড করা হয়। এ ছাড়া তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য সৌদ গোষ্ঠীকে তিন হাজার রাইফেল ও তিনটি মেশিনগান উপহার দেয় ব্রিটেন। (সূত্র: নজদ ও হিজাজের ইতিহাস, পৃ-২১০)

ব্রিটিশ সরকার আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ক্ষমতা গ্রহণের উৎসবে পাঠিয়েছিল স্যার কুকাসকে প্রতিনিধি হিসেবে। রাজা উপাধিতে বিভূষিত করে কুকাস তাকে বলেছিল, “হে আবদুল আজিজ, আপনি শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।”

উত্তরে রাজা বলেছিল, “আপনারাই আমার এ ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন ও এ সম্মান দান করেছেন। যদি মহান ব্রিটিশ সাম্রাজ্য না থাকত তাহলে এখানে আবদুল আজিজ আল-সৌদ নামে কেউ আছে বলেই জানত না। আমি তো আপনাদের (ব্রিটিশদের) মাধ্যমেই ‘আমির আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ’ শীর্ষক খেতাবটি অর্জন করতে পেরেছি। আমি আপনাদের এই মহানুভবতা আজীবন ভুলব না। আর আমার বিগত আচরণ ছিল আপনাদের সেবক ও ফরমানবরদার (গোলাম) হিসেবে আপনাদের ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়ন করা।” ওই উৎসবে কুকাস ব্রিটিশ সরকারের দেয়া শাহী তামগা বা মেডেল রাজা আজিজের গলায় পরিয়ে দেয়। কুকাস বলে যায়: “অচিরেই আমরা আপনাকে হিজাজ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর বাদশাহ বলেও ঘোষণা করব এবং তখন হিজাজকে ‘সৌদি সাম্রাজ্য’ বলে ঘোষণা করা হবে।“ এ কথা শুনে রাজা আজিজ স্যার কুকাসের কপালে চুমু খায় ও বলে: “আল্লাহ যেন আমাদেরকে (সৌদিদেরকে) আপনাদের খেদমত (দাসত্ব) করার ও ব্রিটিশ সরকারের সেবা (গোলামি) করার তৌফিক দেন।”   ( মুহাম্মাদ আলী সাইদ লিখিত ‘ব্রিটিশ ও ইবনে সৌদ’, পৃ-২৬)

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি-ইসরাইল দহরম-মহরম এবং রিয়াদ-তেলআবিব গোপন ও প্রকাশ্য যোগাযোগ যেন নিয়মিত যোগাযোগে পরিণত হয়েছে। সৌদি যুবরাজ সালমান ইসরাইলকে বৈধ রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং ইসরাইলকে মেনে নিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন! কিন্তু ইসরাইল ও সৌদি আরবের এই ঘনিষ্ঠতা যে নতুন কোনো ঘটনা নয় সৌদি আরব গঠনের ইতিহাসেই তা স্পষ্ট। #পার্সটুডে/এমএএইচ/৮