গতকাল ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের সংঘর্ষ দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছি। ভেবেছিলাম কিছু লিখবোনা, কিন্তু না লিখে নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিলো।
আজ থেকে ১৭ বছর আগে ২০০১ সালে প্রথম আমি তাবলীগ জামাতের চিল্লায় যাই এবং এক সাথে ৩ চিল্লা শেষ করি। আমার ঐ জামাতের আমির ছিলেন একজন পরমানু বিজ্ঞানী। সাথে ছিলেন ইনকাম ট্যাক্সের ডিসি,কাস্টম অফিসার সহ বড় বড় কয়েকজন অফিসার, আলেম ও আমার মতো কয়েকজন ছাত্র।
সারারাত জার্নি করে সকালে গিয়ে পৌছালাম গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলায়। ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে সবাই বসলাম মাসোয়ারায় (পরামর্শ সভা)। পরামর্শ সভায় প্রথমেই আমির সাহেব আমাদের সবার কাছে জানতে চাইলেন, আপনারা কেন তাবলীগে এসেছেন ?
একজন একজন করে সবাই তাদের মন্তব্য প্রকাশ করলো। সবার কথা শোনার পর আমীর সাহেব বললেন, সবাই সুন্দর বলেছেন কিন্তু মূল বিষয়ের ব্যাপারে কেউ কিছুই বলেননি। আমির সাহেব বলতে শুরু করলেন: একটা ভরা কলসিতে আপনারা যতই পানি ঢালেন সব পানি বাইরে গড়িয়ে পড়ে যাবে। আপনি যদি খালি কলসিতে পানি ঢালেন তাহলে সেটা কলসির ভেতরে প্রবেশ করবে। আমরা সবাই দুনিয়াবী কাজ দিয়ে আমাদের কলসি আগেই ভরে ফেলেছি তাই আখেরাতের জন্য যাই করিনা কেন সেটা গড়িয়ে বাইরে চলে যায়। তাই প্রথমে আমাদেরকে কলসি খালি করতে হবে। আর এই কলসিটা তখনই খালি হবে যখন আমি আমার ভেতর থেকে ‘আই এম’ শব্দটাকে মুছে ফেলতে পারবো। এই আই এম হলো: আমি একটা কিছু,আমি/আমার/আমিত্বের অহংকার। আমি আমার ভেতর থেকে যখন আমিত্বের অহংকার বের করতে পারবো তখনই দ্বীন আমার ভেতরে প্রবেশ করবে। তাবলীগের এই মেহনতটা হলো আমার ভেতর থেকে আমিত্ব দুর করার মেহনত। তাবলীগে এসে এই মেহনত করতে করতে যেদিন আমার ভেতর থেকে আমিত্বের অহংকার দুর হয়ে সেখানে পরিপূর্ণ দ্বীন প্রবেশ করবে তখন আমার মধ্যে দ্বীনের নূর চলে আসবে। এই নূরের আলোয় আলোকিত হবে আমার জীবন, আমার পরিবার, আমার এলাকা, আমার দেশ ও আমার দুনিয়া। আসুন আমরা আমাদের ভেতর থেকে আমিত্বের অহংকারকে ধ্বংষ করার মেহনত করি। তাহলে দ্বীন আপনাতেই আমার মধ্যে প্রবেশ করবে। আমি নিজে যখন পরিপূর্ণ ইসলামে দাখিল হয়ে কারও সামনে গিয়ে দাড়াবো তখন তাকে আমার দাওয়াত দিতে হবেনা, আমাকে দেখলেই তার দাওয়াত হয়ে যাবে।
আমার আব্বা ১৯৬৩ সাল থেকে তাবলীগ জামাত করেন। উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের উপজেলার সম্মানিত আমির ছিলেন। দ্বীনের পথ ভুলা লক্ষ লক্ষ মানুষ আব্বার হাত ধরে দ্বীনের পথে এসেছেন। আব্বা ছিলেন তাবলীগ জামাতের এক বটবৃক্ষ, যার ছায়ায় এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ শান্তির পরশ পেয়েছে। জন্মের পর থেকেই তাবলীগটা আমাদের পরিবারের একটা অংশ ছিলো, আব্বাকে কেন্দ্র করেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের তাবলীগের কাজ পরিচালিত হতো। এক কথায় বলা যায় তাবলীগটা আমাদের রক্তের মধ্যে প্রবাহীত। কিন্তু, বর্তমান যে তাবলীগ দেখছি (বেশিরভাগের ক্ষেত্রে) সেটা আব্বার করা বা আব্বার মধ্যে দেখা তাবলীগ থেকে যোজন যোজন দুরে। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করে আপনি ৩ চিল্লা দেয়া লোক কিন্তু এখন তাবলীগ করেননা কেন ? আমি মুচকি হাসি আর মনে মনে বলি, যেদিন আমার আব্বার ও আমার সেই আমির সাহেবের দেখানো তাবলীগ খুঁজে পাবো সেদিন আমাকে কারও তাশকিল (তাবলীগে যোগদানের জন্য অনুরোধ) করতে হবেনা। ইনশাআল্লাহ সবার আগে আমাকেই পাবেন।
দাড়ি,টুপি আর লম্বা জামা পড়লেই তাবলীগার বা দ্বীনদার হওয়া যায়না। দ্বীনদার হওয়ার প্রথম শর্তই হলো নিজের মধ্যে থেকে আমিত্বের অহংকার দুর করতে হবে।
গতকাল ইজতেমা ময়দানে যা হলো তা তাবলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ হয়েছে। এই জঘন্যতম কাজটা হতোনা যদি তাদের ভেতরে আমিত্বের বদলে দ্বীন থাকতো। গত বছরের বিশ্ব ইজতেমা থেকে গতকাল পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সবই ঘটেছে একমাত্র ‘আমিত্বের অহংকারের’ জন্যই ঘটেছে। কেউ কারও কাছে ছোট হতে চায়না। এই অহংকার নিয়ে আর যাই হোক দাওয়াতে তাবলীগ হয়না। অহংকারকে বলা হয় আল্লাহর গায়ের চাদর। তোমরা আল্লাহর গায়ের চাদর নিয়ে টানাটানি করবা আর বলবা আমরা মুবাল্লীগ! ছি:
ধিক্কার জানাই তোমাদের মতো তাবলীগারদের যারা তাবলীগের লেবাসে দাওয়াতে তাবলীগ নামক ফুলের বাগান ধ্বংষের খেলায় মত্ত হয়েছো। আল্লাহ হয় তোমাদের হেদায়েত দিক, নাহয় ধ্বংষ করে দিক।
জাকারীয়া খালিদ
লেখক ও সাংবাদিক।