মুক্তাগাছায় ‘বহিরাগত’ খেদাও’ আন্দোলন আ’লীগে, বিএনপিতে দুই ভাইয়ের যুদ্ধ

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘বহিরাগত’ ‘খেদাও’ আন্দোলন চলছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগে। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী এই আন্দোলনে এক মঞ্চে বসেছেন। সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তাদের একমাত্র দাবি, জন্মসূত্রে মুক্তাগাছার বাসিন্দা এমন কাউকে (দলীয় নেতা) একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হোক।

তবে এই ‘বহিরাগত’ যে আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী খালিদ বাবু, তা বুঝতে বাকি রইলো না মাঠ রাজনীতিতে জনপ্রিয় অ্যাডভোকেট বদর উদ্দিন আহম্মেদের কথায়।

রাখঢাক না করেই ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের এই সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমাদের আসনে হুট করে ‘পুইন্না’ (বহিরাগত) কাজী খালিদ বাবু এমপি হয়েছিলেন। মুক্তাগাছার মাইনকুন ইউনিয়নের তালতলা বাজারে তার নানাবাড়ি। আসলে তিনি ময়মনসিংহ নগরের কাঠগোলা এলাকার বাসিন্দা। দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা ‘হায়ার’ করে ভাড়াটিয়া এই প্রার্থীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমপি হয়ে তিনি দলকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।

তার কারণে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আমরা হেরেছি। পৌরসভার মেয়র পদে তিনি বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জঘন্য রকম টাকার খেলা খেলে বিএনপি প্রার্থীদের জিতিয়েছেন, যোগ করেন তিনি।

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দলটির এই মনোনয়ন প্রত্যাশীর বক্তব্যকে সমর্থন করেন দলের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত অ্যাডভোকেট শামসুল হকের সন্তান উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শাতিল মো: তারেক। নৌকার মাঝি হতে তিনিও রয়েছেন আলোচনায়। তারেক বলেন, এমপি থাকার সময়ে বাবু দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। বিএনপি-জামায়াতের ৯৫ শতাংশ লোককে চাকরি দিয়েছেন। দলকে দুর্বল করে গ্রুপিং চাঙ্গা করেছেন। এমনকি প্রশাসনকে ব্যবহার করে দলীয় লোকদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিও করেছেন। রেলওয়েতে ঠিকাদারি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।

বদর, তারেকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে সাবেক পৌরসভা মেয়র আব্দুল হাই আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, এবার মনোনয়ন পেলে কাজী খালিদ বাবুর জামানাত বাজেয়াপ্ত হবে। সংসদ সদস্য থাকাকালে বাবুর সময়ে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর, কাবিখা লুটপাট হয়েছে। তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল সরকার মুক্তাগাছায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, পেট্রোল পাম্প করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। দল কোনো সুবিধা পায়নি।

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে গ্রুপিং-কোন্দলের বাইরে হাঁটছেন ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কার্য নির্বাহী সদস্য রেজাউল করিম রেজা। তরুণ ও উদ্যমী এ রাজনীতিক ধারাবাহিকভাবে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে শেখ হাসিনা সরকারের ১০ বছরের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে এবং নিরবচ্ছিন্ন জনসংযোগ করে ভোটের মাঠে সাড়া ফেলেছেন।

বাস্তববাদী চিন্তা ও জনকল্যাণমূলক ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এ বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন, নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই মুক্তাগাছায় ভালুকার মতো শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠেনি। অথচ এটি গড়ে উঠলে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হতো। উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছাতো প্রাণের মুক্তাগাছা। নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করে আধুনিক ও শিল্পায়ন সমৃদ্ধ মুক্তাগাছা গড়ে তুলবো।

জানা যায়, আসনটি পুনরুদ্ধারের স্বার্থে অ্যাডভোকেট বদর আহম্মেদ, শাতিল মো. তারেক, প্রবীণ নেতা আব্দুল হাই আকন্দ ও কৃষিবীদ নজরুল ইসলাম ‘বহিরাগত’ প্রার্থীর পরিবর্তে স্থানীয় প্রার্থী দিতে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তাদের বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। একই সঙ্গে এবার আসনটিতে তারা নৌকার প্রার্থীও হতে চান।

এসব বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী খালিদ বাবু  বলেন, মুক্তাগাছা আমার মাতৃভূমি আর ময়মনসিংহ শহর হচ্ছে পিতৃভূমি। আমার বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তি সবতো শত বছর যাবত মুক্তাগাছায়। প্রত্যেকে নিজের সুবিধার জন্য ‘বহিরাগত’ শব্দ বলে। আমি ভালো ব্যবসা করি কিন্তু এরপরেও একজিও গাড়ি চালাই। যারা জায়গা দখল, চাঁদাবাজি করে, দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই, তারাই আমাকে নিয়ে অপপ্রচার করছেন। হিংসা-জেদের বশবর্তী হয়ে মনগড়া কথা বলছেন।

আমি সব শর্ত পূরণ করেই রেলওয়েতে ব্যবসা করেছি। এ আসনে এবার লাঙল নয়, নৌকা নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে। নয়তো দল ধ্বংস হয়ে যাবে, যোগ করেন বাবু।

এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্যবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা আহসান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর সহধর্মিণী সেলিমা সোবহান খসরু ও বিটিভির সংবাদ পাঠিকা তাহমিনা জাকারিয়া দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন মুক্তি। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত আচরণ ও জনসংযোগের কারিশমা নির্বাচন জেতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। সেই পথে হেঁটেই নিজের মনোনয়নের পাশাপাশি চলার পথ মসৃণ করেছেন তরুণ সংসদ সদস্য মুক্তি, এমনটিই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা। স্থানীয় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের দাবি, মুক্তির নেতৃত্বে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে প্রাণ এসেছে।

এখানকার প্রতিটি ওয়ার্ডে জাতীয় পার্টি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি ও অফিস রয়েছে। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখানে দলীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা রয়েছেন। মাস খানেক আগে উপজেলা জাতীয় পার্টির কর্মী সমাবেশে জনারণ্য ঘটিয়ে অন্যান্য দলকে ‘বার্তা’ দেন মুক্তি।

তারা বলছেন, পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি জিতলেও ৬৫০০ ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টি দ্বিতীয় হয়েছে। জেলা পরিষদ সাধারণ সদস্য পদে সর্বোচ্চ ৯৪ ভোট পেয়ে মুক্তির স্ত্রী জোসনা আরা মুক্তি বিজয়ী হয়েছেন। সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আজিজুল হক ইদু পেয়েছেন মাত্র ২৯ ভোট। এমন চমক দলের সাংগঠনিক শক্ত ভিত্তিরই দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন তারা।

মহাজোটগত মনোনয়নের বিষয়ে সালাহউদ্দিন মুক্তি বলেন, আমার সময়ে সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। দলগতভাবে আমি মনোনয়ন পাবো এটা নিশ্চিত। জোটগতভাবে ঐক্য হলে এ আসন জাতীয় পার্টির। আওয়ামী লীগের সব শ্রেণির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

এদিকে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মতো নির্বাচন নিয়ে বিএনপির খুব একটা মাতামাতি নেই। তবে এ আসনটিতে মনোনয়ন নিয়ে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন ও তার সৎ ছোট ভাই জাকির হোসেন ওরফে ক্লাসিক বাবলুর মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে।

মূলত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের আসন রাজনীতিতে ‘অপরিচিত’ ছোট ভাই বাবলুকে ছেড়ে দিয়ে সদর আসনে প্রার্থী হয়ে রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিক প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের কাছে পরাজিত হন মোশাররফ। এবার মুক্তাগাছাতেই ফিরে যেতে চান মোশাররফ হোসেন।

বিএনপির শাসনামলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনি মুক্তাগাছায় রেকর্ড উন্নয়ন উপহার দিয়েছেন। সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমি মুক্তাগাছা থেকে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলাম। আমি মুক্তাগাছা আবার থেকেই প্রার্থী হতে চাই। সেখানকার মানুষ আমাকে চান।

এছাড়া দলটির নেতাকর্মীদেরও প্রত্যাশা- ছোট ভাই বাবলু নয়, আসনটিতে বিজয় পতাকা উড়াতেই মোশাররফ হোসেনকে দলীয় প্রার্থী করা হোক। দলীয় নেতাকর্মীদের মতো স্থানীয় ভোটারদের কাছেও খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা নেই বাবলুর।

তাকে প্রার্থী করা হলে ভরাডুবি নিশ্চিত বলেই মত দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান জাকারিয়া হারুন সমর্থকদের। জাকারিয়া হারুন সমর্থকরা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের অনুসারী।

এ বিষয়ে মুক্তাগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাকির হোসেন বাবলুর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সুত্র: বাংলানিউজ২৪।