পুলিশ গ্যালারী নামক ফেসবুক আইডির পোস্ট থেকে নেওয়াঃ কখনো তিনি সবজি বিক্রেতা। ঢাকার কারওয়ান বাজারে কাঁচাবাজারের ডালির ভেতরে ঘুমিয়ে রয়েছেন। কখনো চাকরি না পাওয়া বেকার যুবক। সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হচ্ছেন। বগলে ফাইল, মাথায় হাত, চোখের কোণে পানি। কখনো মলম পার্টির সদস্য। বাসযাত্রীর মুখে রুমাল ধরছেন। কখনো রিকশাচালক। ভাড়া নিয়ে যাত্রী তার গালে চড় তুলেছেন। কখনো ছিনতাইকারী। বাসযাত্রীর হাত থেকে মুঠোফোন ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছেন। আবার তিনিই মাদকসেবীর ভূমিকায়। এসবই তার অভিনয়। আর এই তিনি হচ্ছেন সাঈদ রিমন। পেশায় একজন প্রকৌশলী। রিমন প্রায় ৫০০ দৃশ্যে তার অভিনয়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। প্রতিটি পোস্টে লিখে দিয়েছেন জনসচেতনতামূলক বার্তা। তার এই সচেতনতামূলক পোস্ট ব্যবহার করে পুলিশ বিভাগ দেশের বিভিন্ন শহরে বিলবোর্ড তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীদের দেয়ার জন্য তৈরি করছে ৫০ হাজার স্টিকার। এমনকি পর্যটন পুলিশের ফেসবুক পেজেও ব্যবহার করা হয়েছে রিমনের ফেসবুক পোস্ট।
বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সময় ফেসবুক দেয়ালে প্রায়ই একটি কান্নাজড়িত ছেলের ছবি দেখা যায়। ছেলেটির হাতে ফাইলবন্দী সার্টিফিকেট। এই একটি ছবিই যেন বলে দেয় হাজার বেকার যুবকের না বলা কথা। কোনো ক্যাপশন না থাকলেও ছবির ভাষা বুঝে নিতে কারও দেরি হয় না। দিনের পর দিন যেন বেকার ছেলেরা এভাবেই আশাহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। কান্নাগুলো বুকপকেটেই জমা থাকছে। গুমরে মরা সেই কান্নার শব্দ চাপা পড়ছে সব নৈরাজ্যের গর্জনে। এই যুবকরা অতিকষ্টে গোছানো ভাড়ার টাকায় বারবার ঢাকায় আসেন নিয়োগ পরীক্ষা দিতে। কিন্তু এই আসা যেন শেষই হয় না। আশপাশের অনেকের চাকরি হলেও কোনো এক শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে থাকেন তাদের মতো অনেকে। সেই ফাঁক গলে পেরিয়ে যায় বয়সটাও। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় বারবার পিষ্ট হওয়া তাদের জন্য অনিবার্য। সাড়া জাগানো এমন ছবিটির স্রষ্টা সাঈদ রিমন।
শুধু বেকারত্ব নয়, মাদকের মরণ ছোবল, যাত্রাপথে মলম পার্টির খপ্পর, ট্রাফিক আইন মেনে চলা, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য, শ্রমিক নিপীড়ন, শিশু নির্যাতনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পেশাজীবীর মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একক অভিনীত শতাধিক ছবি রয়েছে রিমনের ফেসবুক ওয়ালে। এমন একটি কাজে উদ্যোগী ভূমিকা শুধু তারই। তবে মহৎ এমন কাজে সহায়তা পান পরিচিত পরিজন, অফিস সহকর্মী এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যেরও। রিমনের এসব ছবি নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন বিলবোর্ড। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন লাইক পেজে ব্যবহৃত হচ্ছে রিমনের এসব ছবি। সম্প্রতি রিমনের এসব ছবি নিয়ে বিলবোর্ড নির্মাণ করেছেন নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নাটোর ও বরগুনা পুলিশ প্রশাসন।
‘যে মুখে ডাকি মা, সে মুখে মাদক না’ স্লোগানে রিমনের মাদক সেবনের ছবি দিয়ে বরগুনা জেলায় ৫০ হাজার মাদকবিরোধী লিফলেট করেছে জেলা পুলিশ। রিমনের এসব স্থিরচিত্রের বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বাসক বলেন, ‘রিমনের একক অভিনীত প্রতিটি স্থিরচিত্র বিশেষ বার্তা বহন করে। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে রিমনের ছবি নিয়ে বিলবোর্ড নির্মাণ করা হয়েছে’। তার ছবি ব্যবহার করা লিফলেটগুলো পুলিশের পক্ষ থেকে বিলি করা হচ্ছে প্রতি শুক্রবার বাদ জুমা মুসল্লিদের হাতে। ধর্মীয় আচারের পর মানুষের মন নরম থাকে। এসময় সচেতনতামূলক কোনো বার্তা পৌঁছলে তাতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। রিমনের এই উদ্যোগকে বিজয় বাসক ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রথমদিকে সাঈদ রিমন জনসচেতনতামূলক ভিডিও নির্মাণ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ভেবে দেখলেন পুরো একটি ভিডিও দেখিয়ে বার্তা পাঠানোর চেয়ে একটি স্টিল ছবির মাধ্যমে বার্তা পাঠানো সহজ। তারপর থেকেই তিনি বিভিন্ন বিষয় ধরে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে থাকেন। বিভিন্ন স্পটে গিয়ে সাঈদ রিমন ছবিগুলো ধারণ করেন। অনেক সময় অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও তাকে সামাল দিতে হয়েছে। ২০১৫ সালে একবার এয়ারপোর্টে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। ছবির বিষয়বস্তু ছিল বিদেশ যাওয়ার পর প্রতারিত হয়ে ফিরে আসা। ছবি তোলার সময় এক অফিসার বুঝতে না পেরে তাদের জেরা করলেও পরে ছেড়ে দেন। কিন্তু ফার্মগেটে মোবাইল তুলে নেয়ার ছবি তুলতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। দৃশ্যটি ছিল কেউ একজন মোবাইলে কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় রিমন তা তুলে নেবেন ছিনতাইকারি সেজে। যার মোবাইল আর ক্যামেরাম্যান জানতেন ঘটনাটি। কিন্তু পাশের মানুষজন জানত না। তিনি যখন মোবাইল তুলে নিচ্ছিলেন আশপাশের মানুষজন এসে তাকে ধরে ফেলে মোবাইল ছিনতাইকারি হিসেবে।
পরে তাদের অনেক কষ্টে বোঝাতে সক্ষম হন। এমন হাজার অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েও রিমন করে যাচ্ছেন নিজের কাজ। সাঈদ রিমনের জন্ম বরগুনা জেলায়। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতকোত্তর করেছেন।
বর্তমানে সাঈদ রিমন চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বস্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে। চাকরির ফাঁকে ছবি তোলেন, ছুটির দিনটিও কাজে লাগান। তাকে সাহায্য করেন সহকর্মী ও কাছের মানুষগুলো। ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে, ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ বক্সগুলোতে তার এই সচেতনতামূলক ছবি ব্যবহার করে বিলবোর্ড বা ব্যানার দিতে চান।
কোনো আর্থিক সহায়তা না থাকায় আপাতত নিজ অর্থায়নেই এসব কাজ চালিয়ে যাবেন। আর সে কারণেই পরিকল্পনা রয়েছে প্রতি মাসে অন্তত একটি দুটি করে ব্যানার ছাপাবেন।
নিজ দায়িত্বে সেগুলো টাঙিয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে তার। প্রথম কি কারণে তিনি এ ধরনের কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ রিমন বলেন, ‘আগে থেকেই চারপাশের অসঙ্গতি দেখে বিব্রত থাকতাম। যে বিষয়গুলো হয়তো সবারই চোখ এড়িয়ে যায়, সেগুলো আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিত। মনে মনে সমাধান খুঁজতাম। ২০১৪ সালে আবদুল্লাহপুর দিয়ে যাচ্ছিলাম। চোখের সামনে দেখলাম আমার এক পরিচিতের গলা থেকে স্বর্ণের চেইনটি ছোঁ মেরে নিয়ে ভেগে গেল এক ছিনতাইকারি। কারও যেন কিছুই করার ছিল না। কিন্তু আমার মনে হলো, আর বসে থাকা নয়, এখনই কিছু করা চাই। আর তখন থেকেই শুরু হলো এ ধরনের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া’। বর্তমানে সাঈদ রিমনের এসব ছবি ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পোস্টারিং ও লিফলেটও বিলি করা হচ্ছে। যাতে মানুষকে আর অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়। এ পর্যন্ত ছবি তুলেছেন ৪৫০-৫০০ এর মতো।
প্রতিটি ছবির মাধ্যমেই জনগণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সচেতনতার বার্তা।
সাইদ রিমন ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি আসক্ত ছিলেন। ভিডিও চিত্র ধারণ ও ভিডিও সম্পাদনার কাজে অভিজ্ঞ বরগুনার বন্ধু রমিজ জাবের টিংকুর সহযোগিতায় জনসচেতনতা বাড়াতে একাধিক রম্য নাটক বানিয়ে বরগুনা শহরের স্থানীয় ক্যাবল টিভির মাধ্যমে তা প্রচার করে ব্যাপক প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি।
ভালো কোনো সুযোগ পেলে নিজের অভিনয় শক্তি দেখাতে চান রিমন। তার প্রমাণও যেন মিলেছে এসব ছবিতে।
২০০৭ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু হয় বাবা আবদুল খালেকের। রিমন তখন নটর ডেম কলেজ থেকে সবে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছেন।
এরপর মা সুলতানা রাজিয়ার প্রচেষ্টায় চলে রিমন ও তার ছোট বোন রাবেয়ার লেখাপড়া।
ছোট বোন রাবেয়া বরগুনা সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। চাকরির সুবাদে এখন ঢাকায় থাকেন রিমন।
রিমনের মা সুলতানা রাজিয়া বরগুনার স্বাস্থ্য বিভাগের একজন স্বাস্থ্য সহকারী। মা এবং ছোট বোন রাবেয়া থাকেন বরগুনার আমতলার পার এলাকার নিজ বাড়ি ‘রিমন’ মঞ্জিলে। ছেলের এমন উদ্যোগী ভূমিকায় মা যথেষ্ট খুশি। সব সময় অনুপ্রেরণা দেন ভালো কিছুর জন্য।
পুলিশ গ্যালারী পরিবারের পক্ষ থেকে এই বীর সৈনিককে জানাই শ্রদ্ধা ও স্যালুট।
ত্রিশাল প্রতিদিন.কম পোস্ট ক্র্যাডিট ——মোমিন তালুকদার