প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের টাকায় টান পড়েছে। এবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় তাই তাদের ছাপানো প্রশ্ন না দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য কাগজও তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।
অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা দিয়ে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আর এতে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন খাতে সাশ্রয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। আর শিশুদের জন্য সামান্য খরচ নিয়ে মাথা ব্যথা। এতেই বোঝা যায় শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে!
আদেশে যা বলা হয়েছে:
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আদেশে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফটোকপির প্রয়োজন হলে বিদ্যালয়ের আনুষাঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন গ্রহণ করা যাবেনা। চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাদা কাগজ বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য পূর্বেই শিক্ষার্থীকে অবহিত করতে হবে।’আদেশে আরো বলা হয়েছে, “মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণের নিকট থেকে কোনো মূল্যায়ন ফি গ্রহণ করা যাবে না।”
শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের কথা:
বাগেরহাট এলাকার একটি উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, তারা চলতি সপ্তাহেই ওই নির্দেশনা পেয়েছেন এবং স্কুলগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন,” আগে উপজেলা শিক্ষা অফিসের ব্যবস্থাপনায় প্রশ্নপত্র ছাপা হতো এবং স্কুলগুলোতে তা দেয়া হতো। আর পরীক্ষার কাগজ(খাতা) স্কুল থেকেই দেয়া হতো। এবার আর তা সম্ভব হচ্ছে না।” তিনি বলেন,” প্রত্যেকটি স্কুলেই বছরে একটি ফান্ড দেয়া হয়। যা থেকে পরীক্ষার ব্যয়সহ চক, ডাস্টারের খরচ বহন করা হয়। কিন্তু এই অর্থ বছরে এখন পর্যন্ত সেই বরাদ্দের টাকা দেয়া হয়নি।”
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান,”এই নির্দেশনায় আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি কী করব তা নিয়ে। কারণ যোগ্যতার ভিত্তিতে যে প্রশ্ন করা হয় তার সব প্রশ্ন এক সঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা যাবে না। তাই মুছে আবার নতুন প্রশ্ন লিখতে হবে। একজনের উত্তর লেখা শেষ হয়েছে, আরেকজনের হয়নি। তখন আমরা কী করব? আর উত্তর লেখার খাতা বাড়ি থেকে আনলে একেকজন একেকরকম খাতা আনবে। আবার কেউ যে কাগজ আনবে তার চেয়ে বেশি কাগজ তার লাগতে পারে। তখন সে লুজ শিট কোথায় পাবে? একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে।”
আদেশে বলা হয়েছে, ‘‘বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে।’’আদেশে বলা হয়েছে, ‘‘বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে।’’
আদেশে বলা হয়েছে, ‘‘বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে।’’
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যানের আওতায় দুইশ’ শিক্ষার্থীর বেশি স্কুলগুলোতে বছরে ৭০ হাজার টাকা, এরচেয়ে কম শিক্ষার্থীর স্কুলে ৫০ হাজার টাকা বছরে বরাদ্দ দেয়া হয়। আর পাঁচশ’ শিক্ষার্থীর অধিক স্কুলে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই ফান্ড থেকেই সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা বিদ্যালয়ে বছরে বার্ষিক পরীক্ষাসহ তিনটি সাময়িক পরীক্ষা নেয়া হতো। আর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের সমন্বয়ে প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন ও প্রশ্ন ছাপানো হতো। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট উপজেলার স্কুলগুলোতে প্রশ্ন পাঠাতো। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষার উত্তরপত্রের খাতা বানাতো।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন,” এই নির্দেশনা দিয়ে বাচ্চাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, বাচ্চারা তোমাদের পড়াশুনার কোনো দরকার নেই।” তার কথা,”করোনার সময় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেয়া হলো কিন্তু শিক্ষায় দেয়া হলো না। আর এখন কৃচ্ছসাধনের জন্য এই বাচ্চাদের বেছে নেয়া হলো! আগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে আসত। এখন আর আসেনা। উন্নয়ন অগ্রগতির প্রথম শর্ত হলো মানব সম্পদের উন্নয়ন। এটা যেন এখানে উল্টো।”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন,” আমরা এখনো এতটা অর্থনৈতিক সমস্যায় পরিনি যে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে। আর এটা সমাজেও একটা নেগেটিভ মেসেজ দেবে। যেমন, আমরা শুনেছিলাম শ্রীলঙ্কায় কাগজের অভাবে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারছে না।” তার কথা,”এটা শিক্ষার্থীদের মনের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তেমনি প্রাথমিক শিক্ষাটা ফ্রি। ফলে এই যে নির্দেশনা তা ফ্রি শিক্ষা নীতি বিরোধী।”
মহাপরিচালক যা বললেন
তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত দাবি করেন,”নির্দেশনার যে সার্কুলার ওটা ঠিক সার্কুলার না । কেউ হয়তো দিয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছাপানো প্রশ্ন দেব। তবে পরীক্ষার খাতা আমরাও দেব শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকেও আনতে পারবেন।”
আপনারা খাতা দিলে বাড়ি থেকে আনতে হবে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,”অনেক সময় খাতায় শর্ট পড়ে। তাই বাড়ি থেকে খাতার আনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।” তিনি দাবি করেন,”কোনো আর্থিক সংকট নেই। পরীক্ষার সময় যাতে কোনো ফি আদায় না করা হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা।”
স্কুলগুলোতো এবছর এখনো উন্নয়ন তহবিল পায়নি। তাহলে তারা পরীক্ষার খাতা ও প্রশ্ন ছাপাবার টাকা কোথায় পাবে? এর জবাবে তিনি বলেন,”টাকা যে স্কুলের প্রয়োজন হবে তারা চাইবে। আর চাইলেইতো দেয়া হবে না। আমরা চেক করে দেখব।”
তবে সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমীন করিমী বলেন,”আমারা ব্ল্যাকবোর্ডে প্রশ্ন লেখা এবং বাড়ি থেকে খাতা নিয়ে আসার নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা স্কুলগুলোকে জানিয়ে দিয়েছি। এর পরে আর কোনো নতুন নির্দেশনা পাইনি।” আর ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের কাছেও আদেশের কপি আছে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা