বাংলাদেশে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর বারবার সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে সেখানে। ইসকনের সন্ন্যাসী তথা বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়েছে। চিন্ময়ের হয়ে মামলা লড়ছেন বর্ষীয়ান আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলিতে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তাঁকে। প্রশ্ন হল, কে এই রবীন্দ্র ঘোষ? তাঁর পরিচয় খুঁজেছে শান্তিসেতু।]
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ও বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচ-এর সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষ বর্তমানে চিকিৎসার কারণে ভারতে অবস্থান করছেন। কলকাতায় থাকাকালে একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন রবীন্দ্র ঘোষ, বিভিন্ন সেমিনারেও দেখা যাচ্ছে তাঁকে। চিন্ময় মামলার শুনানির দিন চট্টগ্রাম আদালতে তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছে, গণমাধ্যমের সামনে এমন গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন রবীন্দ্র ঘোষ । বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও তিনি তাঁর ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। একই অভিযোগ করেছেন, গত বৃহস্পতিবার অল ইন্ডিয়া লিগ্যাল ফ্যোরাম আয়োজিত অ্যাকাডেমিক সিম্পোজিয়াম নামের একটি অনুষ্ঠানে। যদিও বাংলাদেশের তরফে সেই অভিযোগ নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
এবার এই বর্ষীয়ান আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষের সঙ্গে ভারতের জঙ্গি সংগঠন সনাতন সংস্থা এবং তাদের অঙ্গ সংগঠন হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ খুঁজে পেল শান্তিসেতু। শুধু যোগাযোগই নয়, ২০১৮ সালে সংগঠনের সদর দপ্তর গোয়ার রামাথিতে সশরীর উপস্থিত হয়ে তিনি জঙ্গি সনাতন সংস্থার সন্তত্ব (Sainthood) গ্রহণ করেছেন। এমনকী, তাঁর স্ত্রীকেও ৬১% সন্তত্ব প্রদান করা হয়েছে।
অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ১৯৯৯ সালে হিপনোথেরাপিস্ট ডঃ জয়ন্ত বালাজি আথাভালে সনাতন সংস্থা নামে এক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির সদস্যদের বিরুদ্ধে ভারতের একাধিক স্থানে বিস্ফোরণ ঘটানোর অভিযোগ আছে। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের ভাশি, থানে, পানভেল সহ একাধিক সিনেমা হলে বিস্ফোরণের অভিযোগে সনাতন সংস্থার কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে মহারাষ্ট্র পুলিশের এটিএস(অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড)। ২০১১ সালে মুম্বাইয়ের সেশন কোর্ট রমেশ গড়করি এবং বিক্রম ভাবে নামে সংগঠনের দু’জন সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে ১০ বছরের জন্য কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। ২০০৯ সালে গোয়া বিস্ফোরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে প্রশান্ত জুভেকার নামে সনাতন সংস্থার এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। ভারতের একাধিক স্থানে শুধু বিস্ফোরণই নয়, যুক্তিবাদী, সমাজকর্মী ও লেখক গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, এম এম কালবুর্গী এবং গৌরী লঙ্কেশদের হত্যাতেও অভিযুক্ত এই সনাতন সংস্থার সদস্যরা। দাভোলকার হত্যা মামলায় মুম্বাই সেশন কোর্ট এবছরের মে মাসে সচিন আন্ধুরে এবং শরদ কলসকার নামে সংগঠনের দু’জন সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ লক্ষ টাকা করে জরিমানা ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে, গৌরী লঙ্কেশ হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে ২০২০ সালে মহারাষ্ট্র পুলিশ ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের যৌথ অভিযানে পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার উস্তি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রতাপ হাজরা নামে সনাতন সংস্থার সদস্য।
সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইম সহ একাধিক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের ভাশি, পানভেল, থানে,রাজস্থানের আজমেঢ়, মালেগাও সহ একাধিক বিস্ফোরণের তদন্ত করার সময় সনাতন সংস্থার সম্পৃক্ততা খুঁজে পান মহারাষ্ট্রের তৎকালীন এটিএস প্রধান হেমন্ত কারকারে। সেবছরেই তিনি মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে একাধিক নাশকতামূলক কাজে যুক্ত থাকার তথ্যপ্রমাণ সহ একটি রিপোর্ট দাখিল করে সংগঠনটি ব্যান করার আবেদন জানান। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর, মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী আক্রমণে মৃত্যু হয় এটিএস প্রধান হেমন্ত কারকারের। ২০১১ সালে মহারাষ্ট্র সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান সনাতন সংস্থাকে নিষিদ্ধ করতে চিঠি লিখে কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন জানান। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস বিধানসভায় বিবৃতি দেন, পূর্বে মহারাষ্ট্র সরকার সনাতন সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে রেখেছে। কেন্দ্র সরকারের কাছে সেই আবেদন এখনও ঝুলে রয়েছে।
বিস্ফোরণ, হত্যা সহ নানান সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কাজকর্মে লিপ্ত এই জঙ্গি সংগঠন সনাতন সংস্থার সন্ত হলেন চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ। গোয়ার রামাথিতে অবস্থিত সংগঠনটির সদর দপ্তরে নিয়মিত যাতায়াত আছে তাঁর। ২০১৮ সালে ৪ জুন, সনাতন সংস্থার অঙ্গ সংগঠন হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রবীন্দ্র ঘোষ দাবি করেছেন, বাংলাদেশকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে তিনি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে চলেছেন।
সনাতন সংস্থা নামক ভারতের একটি জঙ্গি সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ চিকিৎসা ভিসা নিয়ে ভারতে এসে গণমাধ্যম ও সেমিনারে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ সরকার, পুলিশ এবং বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা বিষয়ক প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ উগরে দিতে পারেন কিনা তার আইনি বৈধতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে কোনও কোনও মহলে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল শান্তিসেতু। সনাতন সংস্থার সঙ্গে রবীন্দ্র ঘোষের যুক্ত থাকার তথ্যকে ভয়াবহ বলে মেনে নিয়েছেন তিনি। তবে বাংলাদেশের আইনে তাঁর কার্যকলাপের বৈধতা কতটা, সে বিষয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। এই প্রসঙ্গে ভবিষ্যতেও নজর রাখবে শান্তিসেতু।
তথ্যসূত্র-শান্তিসেতু
চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষের জঙ্গি যোগ: মিলল তথ্য – Shantisetu