সংসদে পাস হলো আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল

ত্রিশাল প্রতিদিন ডেস্ক:: সংসদে পাস হলো বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল। পাস হওয়া আইনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বহুল সমালোচিত ৫৭সহ কয়েকটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। তবে ওই আইনটির ধারাগুলো নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় যুক্ত করা হয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বুধবার সংসদে বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করা হয়।
বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাইয়ের দাবি করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা বলেছেন, এই বিলে গণমাধ্যমের দাবিগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি পাস হলে মানুষের মত ও স্বাধীনতা প্রকাশের পথ রুদ্ধ হবে।
জবাবে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সবগুলো মতামত এই আইনে প্রতিফলিত হয়েছে। এটি দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক আইন। আমরা সংসদে যারা রয়েছি তারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকছি।
এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর গত ৯ এপ্রিল তা সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।
আইনটি মন্ত্রিসভায় ওঠার পর থেকেই এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে সমালোচনা করে আসছে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এই আইনের ফলে ‘স্বাধীন’ সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে।
খসড়া আইনটি সংসদে তোলার পর তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটিকে প্রথমে চার সপ্তাহ দেওয়া হলেও পরে দুই দফায় তিন মাস সময় বাড়িয়ে নেয় তারা। তবে শেষ দফায় এক মাস সময় নিলেও একদিনের মধ্যে দিন পরেই বৈঠক করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে সংসদীয় কমিটি। পরে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিলটি পরীক্ষা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ীই বিলটি সংসদে পাস হয়েছে।

প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে দুই দফায় সম্পাদক পরিষদ, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি।
সংসদীয় কমিটিতে সম্পাদক পরিষদ খসড়া আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায়।

২০০৬ সালের তথ্যও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় থেকে সরকার তরফ থেকে বলা হয়েছিল ওই আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করে নতুন আইনে বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হবে।

৫৭ ধারায় বলা ছিল, ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

‘কোনও ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬১ ধারায় বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল হবে। এসব ধারায় কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মালিক বা জিম্মাদারের অনুমতি ব্যতিরেকে প্রবেশ; কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত কম্পিউটার সোর্স কোড, গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন, বা অন্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে উক্ত কোড, প্রোগ্রাম, সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক গোপন, ধ্বংস বা পরিবর্তন করার শাস্তি; ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কম্পিউটার রিসোর্সের ক্ষতি-পরিবর্তন বা হ্যাকিং; ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও কম্পিউটার, ই-মেইল বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, রিসোর্স বা সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে এই আইনের অধীন কোনও অপরাধ সংঘটনের চেষ্টার অপরাধের শাস্তি বলা হয়েছে।
৫৭ ধারার বিভিন্ন বিষয় পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে বিভিন্ন ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে।

সংসদে উত্থাপিত বিলের ৮ ধারায় ছিল, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে ওই তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো ব্লক করার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি অনুরোধ করতে পারবে।
ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মনে হয় যে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য দেশের বা দেশে কোন অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে তাহলে বাহিনী ওই তথ্য-উপাত্ত ব্লক বা অপসারণ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মাধ্যমে বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে।
এই ধারায় পরিবর্তনের জন্য সম্পাদক পরিষদ সংসদীয় কমিটিতে প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে এখানে কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।

সংসদীয় কমিটির সুপারিশে এই আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত বিধানে শর্তাংশ যুক্ত করে বলা হয়েছে, “… তবে শর্ত থাকে যে তথ্য অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর বিধানবলি কার্যকর থাকিবে।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “ যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ…।”
বিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের আইনমন্ত্রী ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংসদে উত্থাপিত বিলে ১৮ ধারায় কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং তিন লাখ টাকার বিধান ছিল। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পর এখানে শাস্তি কমিয়ে ছয় মাস কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা দণ্ডের বিধান রেখেছে।

বিলের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ডের বিধানের অংশে সংসদীয় কমিটির মতানুসারে ‘জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা’ যুক্ত করা হয়েছে।
এখানে শাস্তিও কমানো হয়েছে। আগে ১৪ বছরে জেল বা এক কোটি টাকা কিংবা উভয়দণ্ডের বিধান ছিল। এখন কারাদণ্ড ১০ বছরের করার বিধান রয়েছে।

২৫ ধারায় বলা ছিল, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনও তথ্য প্রকাশ করে যা আক্রমণাত্মক, ভীতি প্রদর্শক বা কাউকে নীতি ভ্রষ্ট করে বা বিরক্ত করে; অপমান অপদস্ত বা হেয় করে; রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা বিভ্রান্ত করতে কোনও তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত করে প্রকাশ বা প্রচার করে তবে তা হবে অপরাধ।

এই ধারার চারটি উপধারাকে ছোট করে দুটি উপধারা করা হয়েছে। তবে মূল বক্তব্য প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য শাস্তি কমানো হয়েছে। সংসদে উত্থাপিত বিলে ৭ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। পাস হওয়া জেল কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে।

মানহানিকর তথ্য প্রচার নিয়ে ২৯ ধারায় পরিবর্তনের কথা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সেখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।
বিলে ৩১ ধারায় আইন-শৃঙ্খলা অবনতি ঘটে এমন তথ্য প্রচারের বিষয়ে পরিবর্তন করার দাবি জানায় সম্পাদক পরিষদ।এখানেও কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।

সংসদে উত্থাপিত বিলের ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিক মহলের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল। ওই ধারার ফলে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে মনে করছেন সাংবাদিকরা। সংসদীয় কমিটিতেও বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায় সাংবাদিকরা।
সংসদে উত্থাপিত বিলের ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনও ধরনের তথ্য উপাত্ত, যে কোনও ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছিল।
এখানে সংসদীয় কমিটি পরিবর্তন করার সুপারিশ করে। কমিটির সুপারিশে ‘গুপ্তরচরবৃত্তি’ শব্দ উঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন বলা আছে, যদি কোনও ব্যক্তি ‘অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-১৯২৩ এর আওতাভুক্ত কোনও অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন তা হলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
তবে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে এর ফলে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দটা উঠে গেলেও তেমন কোনও পরিবর্তন আসেনি।

সংসদে উত্থাপিত বিলে এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের জন্য বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের জেল, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, “সাইবার তথা ডিজিটাল অপরাধের কবল থেকে রাষ্ট্র এবং জনগণের জান মাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য।” – তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।