বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মোবাইল টাওয়ার থেকে কেমন মাত্রায় ক্ষতিকর বিকিরণ ছড়ায় তা দেখার কাজ শুরু করেছে বলে বলছেন কর্মকর্তারা।
তবে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেছেন, মানুষের জন্য ঝুঁকি কমাতে যথাসম্ভব নিরাপদ জায়গায় টাওয়ারগুলোকে নতুনভাবে স্থাপন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানকে।
এতদিন মোবাইল কোম্পানিগুলো নিজেরাই টাওয়ারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতো। এখন তাদের পরিবর্তে চারটি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজটি করার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, “চারটি প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন নতুন আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে যত্রতত্র যেভাবে টাওয়ার আছে – সেগুলো সরিয়ে ফেলা হবে”।
তিনি বলেন দূরত্ব, জনবসতি সবকিছু দেখে টাওয়ার স্থাপন করা হবে এবং সব অপারেটর একই টাওয়ার ব্যবহার করবে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মানুষ কম এমন জায়গাগুলো টাওয়ার স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা হবে।
একই সাথে বিটিআরসি বলছে, টাওয়ারগুলো থেকে কি পরিমাণ রেডিয়েশন বিকিরণ হয় – সেটি পর্যবেক্ষণে নতুন যন্ত্রপাতিও আনা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
প্রকৌশলী সুমন আহমেদ সাবির বলছেন, যে কোনো ধরণের রেডিয়েশন বা রশ্মিই মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তবে বাংলাদেশে মোবাইল টাওয়ার এমনকি ঘরের মধ্যে মানুষ যে ওয়াইফাই ব্যবহার করে সেখান থেকে কেমন রশ্মি বিকিরণ হয় তা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি।
তার মতে শুধু টাওয়ারই নয়, মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলো থেকেও সরাসরি রেডিয়েশন যাচ্ছে মানবদেহে।
“অসংখ্য নিম্ন মানের সেট বাজারে আছে এবং বাংলাদেশের মানুষ সেগুলো ব্যবহারও করছে। কিন্তু এগুলোর রেডিয়েশন ঝুঁকি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই”।
রেডিয়েশন নিয়ে উদ্বেগ ও রিট
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। কিন্তু অপারেটরদের যত্রতত্র টাওয়ার স্থাপন নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ ছিলোনা।
ফলে যেখানে সেখানে বাসা বাড়ির ছাদেও টাওয়ার স্থাপন করে অপারেটররা – যা পরে উদ্বেগের জন্ম দেয়।
মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন নিয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষে কয়েক বছর আগে আদালতে রিট করেছিলেন আইনজীবী মনজিল মুরশেদ। তখন আদালত মোবাইল টাওয়ার রেডিয়েশন এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
পরে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কমিটি করে মন্ত্রণালয় এবং সে কমিটি ঢাকার কিছু মোবাইল টাওয়ার থেকে উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তার প্রমাণ পায়।
“গাইডলাইনে রেডিয়েশন মাত্রা আন্তর্জাতিক নন আয়জনিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপি’র নির্দেশনা মতো দশ মেগাহার্টজে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি জনসংখ্যা ঘনত্ব ও পরিবেশ বিবেচনায় এটি বাংলাদেশে হওয়া উচিত দশ ভাগের এক ভাগ”।
মিস্টার মুরশেদ বলেন, রিট করার সময় তারা রেডিয়েশন মানবদেহের জন্য যেসব ঝুঁকি তৈরি করে তা এবং অনেক জায়গায় টাওয়ারের পাশে গাছ কিংবা পাখির ক্ষতির বিষয়গুলো আদালতে তুলে ধরেছিলেন।
তিনি জানান গাইডলাইন নিয়ে আগামী রোববার আদালতে আবারও শুনানি হবে।
টাওয়ার বা মোবাইল রেডিয়েশন কি কি ক্ষতি করে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ড: গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা তাঁর নিজের গবেষণার কথা উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন টাওয়ার রেডিয়েশনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়ে শিশুরা।
“রেডিয়েশন সবার জন্যই ক্ষতিকারক। মানুষের শরীরে সেলগুলো একে অন্যের সাথে যেভাবে যোগাযোগ করে তাকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে এক্সটারনাল রেডিয়েশন। আর এর পরিণতিতে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও তৈরি হয়। তবে বাচ্চাদের শরীরে ফ্লু্ইড বেশি থাকার কারণে তারা বেশী আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে”।
ড: গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা বলেন, শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এ রেডিয়েশন ভূমিকা রাখার আশংকা আছে। এর বাইরেও যে কারো মধ্যেই জেনেটিক পরিবর্তন, অবসন্নতা, লিউকেমিয়াসহ আরও কিছু রোগের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে রেডিয়েশনের কারণে।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতাল মডার্ন ডায়াগনস্টিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেডিওলোজী বিভাগের প্রধান ফরিদ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন – রেডিয়েশন মানব দেহকোষের ক্রোমোজোমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে খুব খারাপ ধরণের টিউমার হতে পারে – যা ক্যান্সারে রূপ নেয়ার আশংকা থাকে।
তিনি বলেন, “শুধু রেডিয়েশন কেনো, আমরা যে মোবাইল সেট একেবারে কানের কাছে নিয়ে কথা বলি – এর ফলে ব্রেইন টিউমার হওয়ার আশংকা থাকে। কারণ রেডিয়েশনটা সরাসরি মস্তিষ্কের সংযোগ হয়ে পড়ে”।
আন্তর্জাতিক নন আয়নাইজিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপি মানবদেহের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কথা বলছে তাহলে এ রেডিয়েশন থেকে কানের বা মস্তিষ্কের টিউমার। এছাড়াও মাথাব্যথা, হৃদরোগসহ, ঘুম ঘুম ভাব, নিদ্রাহীনতা কাজের ব্যাঘাত ঘটাসহ অনেকগুলো সমস্যার কথা প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর ভারতের এক গবেষণায় বলা হয়েছে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন চড়ুই, মৌমাছি, শালিক, টিয়া, টুনটুনি সহ আমাদের পরিচিত অনেক পাখির জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত।
প্রকৌশলী সুমন আহমেদ সাবির বলেছেন, যেসব বাসা বাড়ির ছাদে টাওয়ার আছে তার আশপাশের সবাই যেমন ঝুঁকিতে পড়ে তেমনি কাছাকাছি গাছের ফল ও পাখিও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
কত টাওয়ার আছে বাংলাদেশে
বাংলাদেশে শহর থেকে গ্রাম গঞ্জ থেকে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে পাঁচটি মোবাইল অপারেটরের প্রায় চল্লিশ হাজার টাওয়ার।
কর্মকর্তারা ও প্রকৌশলীরা আশা করছেন, এখন টাওয়ার ভাগাভাগির কারণে এ সংখ্যা অনেক কমে আসবে।
তবে একই টাওয়ার একাধিক অপারেটরের ব্যবহার উপযোগী হতে হলে টাওয়ারগুলো শক্তিশালীও করতে হবে ।
সে দিকটি বিবেচনায় রেখেই যতটা সম্ভব জনবসতি থেকে দুরে ও নিরাপদ জায়গায় টাওয়ারগুলো স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে।
তবে টাওয়ার ব্যবসার লাইসেন্স এখন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার কারণে টাওয়ার সংখ্যা কমে গেল পরিবেশ দূষণের ঝুঁকিও অনেক কমে যাবে।