ত্রিশালের ছেলে এএসপি দিদার নূরের প্রাপ্তির গল্প

শামিম ইশতিয়াক, ত্রিশালঃ সুতিয়া নদীর পাড় ঘেষা ত্রিশাল উপজেলার কোনাবাড়ী গ্রামের মরহুম ডাক্তার নূরুল ইসলাম ও মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে দিদার নূর, ডাকনাম মাসুদ, বড় এক ভাই ও এক বোনের পর পরিবারের ছোট ছেলে মাসুদ, তাই মা বাবা ভাই বোন সবার চোখের মনি হয়ে বেড়ে উঠা হয় তার, আর দশটা ছেলের মতই দুরন্তপনায় কেটেছে তার শৈশব, দিনের শুরুতে স্কুলে যাওয়া, স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে হৈহুল্লোড়, ভরদূপুরে সুতিয়ার জলে সাতার কাটা, বন্ধুদের সাথে কাদাছিটাছিটি আর বিকাল কাটতো ফুটবল ক্রিকেট ব্যাট নিয়েই।

মা বাবার চিন্তার অন্ত ছিলোনা এই দুষ্ট ছেলেকে নিয়ে, তাই গ্রাম ছেড়ে ত্রিশালের নওধারে নিজেদের বাসায় এসে উঠে পরিবার সমেত, তাকে ভর্তি করা হয় ত্রিশাল বাজারের ইসলামি একাডেমি স্কুলে, ৩৭তম বিসিএস ৮ম মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া এএসপি দিদার নুরের সফলতার গল্প যেনো শুরু হয় এখান থেকেই।

৫ম শ্রেণিতে সে পেয়ে যায় বৃত্তি, তারপর সফলতার সাথে এসএসসি শেষ করে এই স্কুল থেকেই, তারপর এইচএসসিতে ভর্তি হয় ময়মনসিংহ জেলা শহরের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজে।

দিদার নুরের স্বপ্ন ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার, তাই এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষার জন্য পড়ালেখার ধৈর্যের পরিক্ষায় চেয়ার টেবিলে তার কষ্ট যেনো তার ভাগ্যের চাকা কে একটু ঘুরিয়ে দেয় অন্য দিকে, চান্স পেয়ে যায় মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে Biotechnology & Genetic Engineering বিভাগে।

শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, শুরু হয় বাবার দেখা স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধ, দিদার নূরের বাবা ডাক্তার নুরুল ইসলামের স্বপ্ন ছিলো তার ছেলে মাসুদ বিসিএস ক্যাডার হবে, পুলিশ অফিসার হবে, তাই বাবার দেখা স্বপ্ন কে সত্যি করতে সে লেগে যায় বিসিএস প্রস্তুতিতে, যেখানে অন্য সকল গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করা বেকার ছেলেরা অন্যান্য চাকরি জন্য ইন্টারভিউ দিতে ব্যাস্ত থাকে সেখানে দিদার নূর শুধু মাত্র বিসিএসের জন্য চালিয়ে যাচ্ছিল তার পড়াশুনা, যেনো আত্ত বিশ্বাস তাকে দেখিয়েছিল বর্তমানের এএসপি হওয়ার সেই স্বপ্নটাকেই।

যখন চেয়ার টেবিলে বই খাতা কলমে বাবার স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধে লড়ছিলো দিদার নূর ঠিক তখনি একদিন ওপাড়ের ডাকে সাড়া দিলো তার বাবা ডাক্তার নুরুল ইসলাম, মাথার উপর থেকে যেনো ছায়া চলে গেলো তার, ভেঙ্গে পড়লো মানসিক ভাবে কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো বাবার দেখা সেই স্বপ্নের কথা, তাকে যে বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে। তারপর আবার শুরু হলো তার সেই চেয়ার টেবিলে বাবার স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম।

এখন দিদার নূর এএসপি দিদার নূর, পূরণ হয়েছে তার বাবার স্বপ্ন, সে পেয়েছে তার প্রাপ্তি, শুনে নিন এসএসপি দিদার নূরের মুখ থেকেই তার প্রাপ্তি গল্প–

২০১৮ সালের ১২ জুন। রমজান মাস চলছে। অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই অফিস থেকে এসে চার হাত পা চার দিকে দিয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ এক বন্ধু ফোন দিয়ে বললো ৩৭ এর রেজাল্ট দিছে। রেজাল্টের কথা শুনে আমার তো আত্নারাম খাঁচা থেকে বের হওয়ার অবস্থা। ফেসবুকে ঢুকে দেখি অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ লিখে পোস্ট দিচ্ছে। তিন তিনবার ভাইবা বোর্ড থেকে ক্যাডার বিহীন ফিরে আসায় রেজাল্ট দেখতে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। গলা শুকিয়ে রীতিমতো কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো। অনেকেই আবার ফোন দিয়ে রেজাল্টের খবর জানতে চাচ্ছিলো। উত্তর দিতে পারছিলাম না। তাই অনেকটা সাহস নিয়েই রেজাল্টের কপি ডাউনলোড দিয়ে কিছুক্ষন চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম। মনে মনে ভাবলাম রেজাল্টটা এবার নাহয় দেখি। কপালে যা আছে তাতো হয়েই গেছে। দোয়া দরুদ পড়ে রেজাল্ট শীট ওপেন করে সোজা চলে গেলাম ননক্যাডারে। বারবার ননক্যাডার হওয়ায় প্রথমেই ক্যাডার লিস্টে নিজের রোল খোঁজার সাহস পাচ্ছিলাম না। ননক্যাডারে যেয়ে দেখি সেখানে আমার রোল নেই। মনে মনে ভাবলাম স্যার কি তবে আমাকে ভাইবাতে ফেল করিয়ে দিলো। পুলিশ ক্যাডার যেহেতু প্রথম চয়েজ তাই ভাবলাম ঐখানে একটু দেখি,যদি লাইগা যায়!!

১০০ জনের তালিকার নিচ থেকে দেখা শুরু করি। উপরের দিকে যাই কিন্তু আমার রোল তো আর খুঁজে পাই না। হঠাৎ চোখ আটকে যায় প্রথম সারির ৮ নম্বর রোলটার দিকে। আরে এ যে আমারই রোল!নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এডমিট বের করে দেখি আরে সত্যিই তো এটা আমারই রোল। আনন্দের আতিসয্যে চিৎকার দিয়ে উঠি। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় সাথে সাথেই সিজদায় নত হয়ে পড়ি। সিজদায় পড়ে আমার সে কি কান্না। কান্না মুছে কাউকে ফোন দিয়ে জানাবো সেও শক্তি পাচ্ছিলাম না। কান্নার ঢেউ যেন অবিরাম বেড়েই চলেছে। সিজদা থেকে উঠে অবচেতন মনে বাবার নাম্বারে ফোন দিই। পরক্ষণেই মনে হয় বাবা তো বেঁচে নেই। ভাইয়া ও আম্মাকে ফোন দেয়ার পর রেজাল্ট শুনে দেখি তারাও কাঁদছেন। ফোনের এ পাশে কাঁদছি আমি আর ও পাশে কাঁদছে তারা। এ যে আনন্দের কান্না, এ যে হাজারটা স্বপ্নভঙ্গের পর স্বপ্নপূরণের কান্না। আনন্দের কান্না যে এত মধুর হয় তা আমার আগে কখনো জানা ছিলো না। ১২ জুন দিনটাকে চাইলেও আমি কখনো ভুলতে পারবো না। জীবন সায়াহ্নে গিয়েও কেউ যদি আমাকে জীবনের স্মরণীয় দিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে আমি চোখ বন্ধ করে ১২ জুনের কথা বলে দিবো। কারন এ যে আমার স্বপ্নপূরণের দিন,সব হারিয়ে সব ফিরে পাওয়ার দিন।