সন্দ্বীপের সাড়া জাগানো শিশু অপহরণের ঘটনায় পুলিশ এবং স্থানীয় জনগণ যেভাবে একসাথে কাজ করেছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় চলছে।
২০শে নভেম্বর আহসান হোসেন জারিফ নামে এক শিশুকে অপহরণ করা হয়।
জারিফকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় তার পরের দুইদিন ধরে বহু তরুণ সন্দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু করে। এই অপহরণের ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে দেয়ার জন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও ব্যবহার করে।
সেদিন গভীর রাতে অপহরণকারীরা জারিফের ব্যবহার করা স্কুল ড্রেসটি বাড়ির বাইরে ফেলে রেখে যায় যার ভেতরে ছিল একটি চিরকুট।
আর তাতে মুক্তিপণ হিসেবে চার লাখ টাকা দাবি করা হয়। জারিফের বাবা মো. জ্যাকব সকালে সেই চিরকুট পেয়ে থানার সাথে যোগাযোগ করেন।
তারপর কী হলো?
সন্দ্বীপ থানার এস আই মো. হেলাল খান বলেন, এই ঘটনা জানাজানির পর প্রথমে একটি জিডি করা হয়। আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে আমরা এই অপহরণ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করি।
এরপর স্কুল ভ্যান ড্রাইভারকে সনাক্ত করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। পাশাপাশি এই কাজে আমরা সাধারণ মানুষকে জড়িত করি।
জারিফের বাবা মো. জ্যাকব যেমন মাইকিং শুরু করেন। তেমনি আমরাও মাইকিং করি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সজাগ করার চেষ্টা করি।
অপহরণকারীরা চিরকুটে যে মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়েছিল আমরা তার অবস্থান জানার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এই অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে এতটাই হৈচৈ শুরু হয় যে চার স্থানীয় যুবক সিদ্ধান্ত নেন তারাও তাদের মতো করে প্রশাসনকে সহায়তা করবেন। এরা হলেন: ফিরোজ খান পাবেল, হান্নান তারেক, সজিব খান এবং জাহিদ হাসান শাকিল।
সন্দ্বীপ বাসিন্দা হান্নান তারেক বলেন, জ্যাকব ভাইকে দেখে বুঝলাম তিনি অনেক হতাশ হয়ে গেছেন।
ঠিক তখন আমরা একটা সিদ্ধান্ত নেই। আমরা ঠিক করি পরের দিন ভোর থেকে আমরা সন্দেহজনক জায়গাগুলোতে নিজেরা তল্লাসি করবো।
সকলের সহযোগিতা কামনা করে জ্যাকব ভাইয়ের একটি এক মিনিটের ভিডিও পোস্ট করি। যেটা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে।
জ্যাকব ভাই জানালেন রাতের কোন এক সময় জারিফের স্কুল ড্রেস ও সাথে একটা চিরকুট রেখে গেছে কেউ এক জন।
চিরকুটে একটি ফোন নাম্বার ছিলো। আমরা সেটা আমাদের মোবাইলে সেভ করলাম। দেখলাম ইমোতে তাহমিনা নামে একটা আইডি শো করছে। এটা আমাদের প্রথম ক্লু।
জ্যাকব ভাইসহ উনার পরিবারের সবাইকে ছবি এবং এই নামে কাউকে চেনে কিনা জিজ্ঞাস করলাম। কিন্তু কেউ চিনলেন না।
পরের দিন পুলিশ যখন মোবাইল নাম্বার ট্র্যাক করে জানালো যে সেটা নয় দিন ধরে বন্ধ। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আমাদের টিম একমত হলাম যে প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা এই ক্লু ধরে নিজেদের মত আগাবো।
প্রথমে রবির নাম্বারটা নিয়ে চট্টগ্রামে আকবর নামে আমাদের এক ফ্রেন্ডকে ফোন করে সাহায্য চাই। নাম্বারটা কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা তা বের করে দিতে বলি।
সে জানালো সে শুধু আইডি নাম্বার আর ডেট অব বার্থ দিতে পারবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেটা পেয়ে গেলাম। এখন কাজ আইডি কার্ড বের করা। কিন্তু সকাল হওয়ায় সব বন্ধ থাকায় তখন নেয়া সম্ভব ছিলো না।
সন্দ্বীপ থানার এস আই মো. হেলাল খান বলেন, আমাদের ওসি স্যার, সার্কেলের স্যার এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সাহায্যে আমরা আইডি কার্ড-এর তথ্য জোগাড় করি।
সেই তথ্য ইমোতে পাওয়া নামের সাথে তা মিলে যায়। পাওয়া যায় ঠিকানা। যা জারিফদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না।
যেহেতু আমিসহ বেশ কয়েকজন কয়েক মাস ধরে থানায় আছি, তাই আমরা সামনে থাকলে চিনে ফেলতে পারে।
সেই জন্য আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা ঐ বাড়িটিতে অভিযান চালাবো খুব গোপনে। এবং ভাগে ভাগে। ঠিক হলো প্রথমে তিন-চার জনের একটা দল ঐ ঠিকানায় যাবে।
আমরা পুলিশের লোকজন ২০০/৩০০ গজের মধ্যেই থাকবো। ফোন করা মাত্রই আমরা হাজির হয়ে যাব।
সন্দ্বীপ বাসিন্দা হান্নান তারেক জানান, শুরু হলো আমাদের অভিযান। দর্জি পুকুর মোড়ে জারিফের বাবাকে নামিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আমাদের টিমের সজিবকে রাখা হয় অবস্থা বুঝে জারিফের বাবাকে নিয়ে যেতে।
জাহিদ, ফিরোজ এক মোটর সাইকেলে। আমি আর এলাকার অন্য একজনসহ (তিনি আমাদের প্ল্যানের ব্যাপারে অবগত ছিলেন না) আমরা আমাদের টার্গেট বাড়ি থেকে একটু দূরে মোটর সাইকেল রেখে অবস্থান নেই।
এর মধ্যে সেখানে বাউরিয়া ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রবিউল মাওলা চলে আসেন। তাকে দিয়ে ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বারকে ফোন করে আনা হয়।
কারণ আমরা যে বাড়িতে ঢুকবো সেটা ৬নং ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। এখানে বলে রাখি যেহেতু আমরা প্রশাসনের কেউ না তাই কোন বাড়িতে সার্চ করতে গিয়ে যাতে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সে জন্য আমরা স্থানীয় মেম্বারদের সাহায্য নিয়েছি।
এছাড়াও আমরা আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি কারণ অপহরণকারীরা সংঘবদ্ধ হতে পারতো। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারতো।
কিন্তু সব ঝুঁকি ছাপিয়ে আমাদের কাছে মুখ্য ছিল জারিফকে উদ্ধার করা। সন্দ্বীপ থানার এস আই মো. হেলাল খান বলেন,, স্থানীয় মেম্বারকে সাথে নিয়ে আমাদের দল তাহমিনার ঘর খুঁজে বের করে।
তাহমিনার ঘরের সামনে একজন দাঁড়ানো দেখে নাম জিজ্ঞাস করার পর সে নিজেকে ফাহিমা বা অন্য একটা নাম বলে।
কিন্তু ভ্যান ড্রাইভারের বিবরণে বলা হয়েছিল জারিফকে যে মহিলা নিয়ে গেছে সে প্রেগন্যান্ট ছিল। ঐ মহিলাও প্রেগন্যান্ট দেখে তাকে আটক করা হয়।
তার নাম, বাবার নাম এবং তার আইডি’র ছবি থেকে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল। তখন ফিরোজ তার ঘরে ঢুকে পড়ে। অন্ধকার ঘরে ঢুকে সে দেখে কম্বল জড়ানো একটি শিশুকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর জারিফকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। ফোন পাওয়া মাত্র আমাদের ফোর্স গিয়ে সেখানে হাজির হয়। ঐ মহিলাকে আটক করা হয় এবং জারিফকে তার বাবার কোলে তুলে দেয়া হয়।
এই ঘটনার পর আটক মহিলার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আমরা আরও কয়েকজনকে আটক করেছি।
মামলার তদন্ত এখনও চলছে।