কেন চাই সহজ বিয়ে

ছবি তুলেছে বাচ্চাটার মা। চবি দর্শন বিভাগে ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। বিয়ে করেছে ইন্টার পরীক্ষার আগে। এটি ওর ৩য় সন্তান। আমি আর্লি মেরেজের পক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিস্টেমটাই এমন যেন মেয়েরা পড়াশোনা করা অবস্থায় বিয়ে না করে। ‘বিয়ে করা যাবে না’ এমন কোনো আইন না থাকলেও পুরো ব্যবস্থাটাই মাতৃত্বের জন্য চরম বিরূপ ও প্রতিকূল। পড়াশোনার অজুহাতে এখানকার মেয়েরা পারিবারিক জীবন ও মাতৃত্ব হতে মাহরুম থাকতে বাধ্য হয়।

‘পড়াশোনার অজুহাতে’ কথাটা এভাবে বলার কারণ হলো, কী পড়া হচ্ছে, কেন পড়া হচ্ছে, ন্যূনতম মানে হলেও হক আদায় করে পড়া হচ্ছে কিনা, শিক্ষা সমাপনান্তে কী হবে, এসবের কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। ‘চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ি’ টাইপে চলছে পুরো উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা।

আমাদের কন্যাদেরকে আমরা একটা নির্দয় ও চরম অনুচিত বিকল্পের মুখোমুখি করি। তা হলো, ‘শিক্ষা অথবা পারিবারিক জীবন’ দু’টার মধ্য থেকে যে কোনো একটাকে বেছে নাও। নানাবিধ কারণে মেয়েরা শিক্ষা নামক এই লোকাল ট্রেনে উঠে বসে। বয়স ২৫/২৬ হওয়ার আগ পর্যন্ত এর থেকে নামার সুযোগ নাই।

আফসোস আমার কন্যাদের জন্য…! (সঙ্গলাভ, পরিবার গঠন ও মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তি পূরণের জন্য) জীবনের সবচেয়ে উপযোগী সময়ে তারা থাকে অবিবাহিত। বিয়ের পর তারা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) চেষ্টা করে মাতৃত্বকে ঠেকানো বা বিলম্বিত করার জন্য। এরপর তিরিশের কাছাকাছি গিয়ে যখন তারা মা হওয়ার চেষ্টা করে তখন তাদের জন্য তা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর কাজ।

কোনোমতে একটা বাচ্চা হওয়ার পর এরপরে দ্বিতীয়টা হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের খবর হয়ে যায়। এটি কোনো প্রকার রাখঢাক বা সংকোচের ব্যাপার নয়। এই ক্যাম্পাসে অনেক শিক্ষক সম্পর্কেই জানি, তারা একটা বাচ্চা হওয়ার পরে গ্যাপ দিছে। এরপরে যখন বাচ্চা নিতে চাইছে তখন বাচ্চা আর হচ্ছেই না।

সোশালি ইনকারেক্ট এ’সব কথা বলার হিম্মত বা নৈতিক বল আমার সহকর্মীদের দেখছি না। আমার প্রশ্ন, কেন নয় শিক্ষা ও পারিবারিক জীবন একসাথে? কেন আমাদের মেয়েদেরকে একটার বিনিময়ে সেক্রিফাইস করতে হবে আরেকটাকে?

বয়ফেন্ড রাখা যাবে, লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে প্রকাশ্যে ব্রেকআপের ঘোষণা দেয়া যাবে, জাস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে জুটি বেধে এখানে-ওখানে বেড়াতে যাওয়া যাবে, কাউকে পছন্দ হলে বা পরিবেশ পেলে ‘মেইক আউট’ করা যাবে, নিদেনপক্ষে ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার কারণে সপ্তাহে নিয়ম করে মাস্টারবেইট করা যাবে, মাতৃস্নেহে বিড়াল পালা যাবে, কিন্তু কোনোক্রমেই বিয়ে করা যাবে না।

বিয়ে করতে হলে বহুকিছু লাগবে, কিন্তু বিয়ে বহির্ভূত সব ইয়ে করার জন্য কিছুই লাগবে না। সম্মতিই যথেষ্ট।

ছি! থুতু মারি এই সমাজের মুখে। পদাঘাত করি এই সামাজিক অপব্যবস্থার বুকে। ওয়েস্টের হাইস্কুল ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে প্রচলিত হুকআপ কালচার এখানেও চলে আসতে আর বাকী নেই – না, কথাটা আমি এমনভাবে বলতে পারছি না। অলরেডি এখানে সেক্স রেভুলেশান সফট কোরে শুরু হয়ে গেছে। বৃহত্তর সমাজ যদি অনেকবেশি রক্ষণশীল না হতো, ফেয়ার ভর্তি পরীক্ষার কারণে অধিকাংশ স্টুডেন্ট যদি গ্রাম থেকে উঠে না আসতো, তাহলে কী হতো তা খুব দূরে নয় এই দিল্লির জেএনইউ’র খবর নিলেই আপনারা ঘটনা বুঝে যেতেন।

এই দুর্নিবার যৌনবিপ্লব ঠেকাবার একমাত্র পথ ‘সহজ বিয়ে’র ব্যাপক প্রচলন। পারিবারিকভাবে করা সরকারী বিয়ে হোক অথবা নিজেরা নিজেরা সেরে ফেলা বেসরকারী বিয়ে হোক, যারাই বিয়ে করে নেয় তাদেরকে আমি সর্বোতভাবে সহযোগিতা করি। বিয়েটাকে আমি নিচের দিক থেকে দেখি। যেনার উত্তম বিকল্প হিসেবে দেখি। তাই বিয়ে নিয়ে আমার এক্সপেক্টেশান মিনিমাম, ফ্যাসিনেশান ম্যাক্সিমাম।

আমরা একটা প্যারাডিগমেটিক কনফ্লিক্টের মধ্যে আছি। অলরেডি লুজার পজিশনে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি নামক জাইগান্টিক রেপটাইলের কামড় অলরেডি আমরা খেয়ে ফেলেছি। ওর চোয়ালের নিচে আমাদের মুখ। আমাদের মাথাটা প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই তরুণ প্রজন্মকে সহজ বিয়ের ভেন্টিলেশান দেয়া। প্রসঙ্গ আসলেই বলি, কতোবার কতো জায়গায় কতো জনকে বলেছি এই কথাটা, ventilation prevents explosion।

ভাবতে পারেন, হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু নাই কোনো সেনিটারি টয়লেট? যে যেখানে যেভাবে পারে কাজ সারছে ….! কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইয়থফুলনেস নিয়ে এটাই হচ্ছে। সাংস্কৃতিকভাবে চরম উস্কানীমূলক পরিবেশে এখানকার হাজার হাজার নর নারী আজ অসহায়। রাজনৈতিক স্বৈরাচারের চেয়েও বড় নিপীড়ক হলো বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অপব্যবস্থা। এখানে স্বাভাবিক পন্থায় সহজাত প্রবৃত্তি পূরণের কোনো ব্যবস্থা নাই। এর বিপরীতে আছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থাকে ভেংগে ফেলার সব ব্যবস্থা। অস্বাভাবিক যত পদ্ধতি হতে পাারে তা সবকিছুর পথ এখানে দিবারাত্রি অবারিত। নানাভাবে। অস্বাভাবিকতাই এখানে স্বাভাবিকতা। স্বাভাবিকতা এখানে অবমাননাকর ও অগৌরবের বিষয়।

কথা একটাই, শিক্ষা সংস্কার ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব। এক শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে সহজেই সাধিত হতে পারে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন ও সংস্কার।

দোয়া রইলো ছোট্ট সোনামণি ‘দোয়া’র জন্য। হ্যাঁ, বাচ্চাটার নাম ‘দোয়া’। ক্লাসটা ছিল ফিলসফি অব এআই এর ওপরে। আজকের বিষয় ছিল সায়েন্স ফিকশান মুভি ’টার্মিনেটর টু’ এর রিভিউ।

আজকের এই ক্লাসেই আমার জানা মতে, আরো কয়েকজন ছাত্রী ছিল যারা বিবাহিত। ’দোয়া’র মা ক্লাসের পরে আমাকে বলেছে, ওদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছে যারা বিয়ের পরেও পড়ছে। আমি আশাবাদী। নিশ্চয়ই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। শীঘ্রই এমন দিন আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পরই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে। দাম্পত্য জীবনের সুরক্ষার মধ্যে থেকেই তারা পড়ালেখা কন্টিনিউ করবে।

ভাবতে পারেন, এতবড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ডে কেয়ার এর ব্যবস্থা নাই?

পুরাতন কলাভবন ৩৪১ নং রুম হতে ক্লাস নিয়ে বের হওয়ার পর বারান্দাতে দেখলাম একটা বাচ্চাকে। একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে শোয়ানো। পাশে একজন বয়ষ্ক মহিলা। বাচ্চাটার দাদী অথাব নানী। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, বাচ্চাটার মা পাশের একটা ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। সে ক্লাসে আছে। শুরুতেই বলেছি, বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনা করা এখানে অত্যন্ত কঠিন। এখানকার সকল ব্যবস্থা পাশ্চাত্য ধাঁচের, কেবল ডে কেয়ার এর ব্যবস্থা ছাড়া। প্রমথ চৌধুরী অনেক আগেই বলেছেন, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নহে।

চাই, বিবাহিত ছাত্রীদের মাতৃত্বজনিত ‘ছুটির’ ব্যবস্থা। চাই, শাটল ট্রেনে বাচ্চা নিয়ে আসা ছাত্রীদের জন্য আলাদা বগি ও সিট প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। তাদের জন্য চাই হলে আবাসনের নিশ্চয়তা। প্রতিটা ফ্যাকাল্টি বিল্ডিংয়ে চাই ব্রেষ্ট ফিডিং কর্ণার। অত্যন্ত জরুরী হলো ক্যাম্পাসব্যাপী মানসম্পন্ন ডে কেয়ার সিস্টেম চালু করা।

বিয়ে ব্যবস্থারই বিরোধী, আমার এমন সহকর্মীরা আমার এ’সব প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করবে, এটি নিশ্চিত। মেয়েরা অনেক সময়ে ক্লাসে আলাদাভাবে বসে, এতেই তাদের প্রবল আপত্তি। ক্লাসে কেউ বাচ্চা নিয়ে আসবে, এটি তাদের কাছে অকল্পনীয়। বিবাহিত বিশেষ করে মা হয়েছে এমন ছাত্রীদের হেনস্থা করার কাজে তারা অতিউৎসাহী। ভুক্তভোগীরা জানে স্যারদের চেয়ে ম্যাডামরা এ’ নিপীড়নমূলক কাজে অগ্রণী।

এখানে একটা কথা ক্লিয়ার করা দরকার। চবি দর্শন বিভাগের সকল শিক্ষক অনেক বেশি স্টুডেন্ট-ফ্রেন্ডলি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছাত্র-ছাত্রীদের পারষ্পরিক সম্পর্কও অত্যন্ত ভালো। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি মশহুর। উপরের প্যাারায় আমি যা বলেছি তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই বলেছি।

এগেইন, দোয়ার জন্য এবং ওর মায়ের জন্য এবং এ ধরনের সব মা’দের জন্য আপনারা দোয়া করতে ভুলবেন না। ভালো থাকেন।

লেখকঃ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক।

পরিচালক, মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র। সামজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র।