শাহ মাহমুদ হাসান::প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মহব্বত ও ভক্তি-শ্রদ্ধা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এসব মানবিক গুণ আছে বলেই এখনও টিকে আছে এ নশ্বর পৃথিবী। আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেনÑ ‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রুম : ২১)। ভালোবাসার অভাবে মানুষ নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হয়ে ওঠে। ভালোবাসাশূন্য মানুষটির কাছে কেউই নিরাপদ নয়। সত্যিকার ভালোবাসার অভাবে সৃষ্টি হয় হিংসা-বিদ্বেষ, গুম, খুন ও ধর্ষণের মতো অসংখ্য অপরাধ। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। তাই তো পরম মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে রাসুল (সা.) এসেছিলেন এ ধরায়। আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.) কে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য করুণার মূর্তপ্রতীক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হয়েছেÑ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)।
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা
ঈমানের পরিপূর্ণতা নির্ভর করে সঠিকভাবে ভালোবাসা প্রয়োগের ওপর। আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘তোমাদের কাছে যদি তোমাদের বাবা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পতœী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধনসম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়; তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’ (সূরা তওবা : ২৪)। এজন্য ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানদারের ভালোবাসা হতে হবে সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিত ও নিঃশর্ত। কেননা ভালোবাসা পাওয়ার সব থেকে বড় হকদার হলেন আল্লাহ তায়ালা। মানুষ যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার সব যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় রয়েছে শুধু আল্লাহর মাঝে। ঈমানদারের ভালোবাসা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বাণীÑ ‘যারা ঈমানদার আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা মোশরেকদের তুলনায় বহুগুণ বেশি।’ (সূরা বাকারা : ১৬৫)।
আবার আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে একাত্ববাদের ওপর বিশ্বাস ও নেক আমল করতে হবে, অন্যথায় আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যাবে না। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের দয়াময় আল্লাহ ভালোবাসা দেবেন।’ (সূরা মরিয়ম : ৯৬)।
নবীর প্রতি ভালোবাসা
মানবসমাজে সর্বাধিক ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম পাত্র হচ্ছেন নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। উম্মতে মুহাম্মদির প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও অবদান সবচেয়ে বেশি। এজন্য আল্লাহর পরেই ভালোবাসতে হবে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে। অন্যথায় প্রকৃত ঈমানদার হওয়া যাবে না এবং ঈমানের স্বাদও পাওয়া যাবে না। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘তোমাদের কেউ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার বাবা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।’ (বোখারি : ১৪)। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘তিনটি জিনিস এমন, সেগুলো যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ পাবে। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তাঁর কাছে অন্য সবকিছু থেকে প্রিয় হওয়া। ২. কাউকে শুধু আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং ৩. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেভাবে অপছন্দ করে, তেমনি ফের কুফরির দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে অপছন্দ করে।’ (বোখারি : ৬৪৭২)। প্রিয়নবী (সা.) এর আদর্শ অনুসরণ করাই হলো আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার উপায়। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদের ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।’ (সূরা ইমরান : ৩১)।
সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ইসলামের শিক্ষা। মানবপ্রেম সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘আর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা রুম : ২১)। রাসুল (সা.) বলেছেনÑ ‘তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার পরস্পরকে ভালোবাসতে না পারা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের খবর দেব না, যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে সক্ষম হবে? (তা হলো) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন করবে।’ (মুসলিম : ২০৩)। মানুষকে ভালোবাসা ও তার সঙ্গে সম্পর্ক করার ক্ষেত্রেও আল্লাহর রেজামন্দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া পরিপূর্ণ ঈমানের দাবি। হাদিসে এরশাদ হচ্ছেÑ ‘যে কেউ আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্যই অপছন্দ করে এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে কিছু দিয়ে থাকে এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তার ঈমান পরিপূর্ণ হলো।’ (আবু দাউদ : ৪০৬১)। একজন মানবের ভালোবাসা একজন মানবীও পেতে পারেন; তবে সে ভালোবাসা হতে হবে বৈধ ও অনুমোদিত। যেমন স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা বহুবিধ পুণ্যময় কাজ। ইসলাম প্রতিটি মুহূর্তেই স্বামী-স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রেরণা দেয়। রাসুল (সা.) স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রেরণা দিয়ে বলেছেনÑ ‘তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম; আমিও আমার স্ত্রীদের কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)।
অবৈধ ভালোবাসা ব্যভিচার উসকে দেয়
ভালোবাসার ক্ষেত্রে মানতে হবে ইসলামি অনুশাসন। বৈধ কোনো সম্পর্ক ছাড়া ইসলামে একজন মানব-মানবীর মধ্যে হৃদয়ের কোনো টান থাকা গভীর প্রেম অনুভব করার সুযোগ রাখা হয়নি। কারণ সে ক্ষেত্রে ব্যভিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। ব্যভিচারকে যারা পছন্দ করে তাদের বিরুদ্ধে কোরআনের হুঁশিয়ারি হচ্ছেÑ ‘যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।’ (সূরা নুর : ১৯)। ব্যভিচার করার আগ্রহ তৈরি হতে পারে, এমন কাজের ধারে-কাছে যেতেও কোরআন নিষেধ করেছে। এরশাদ হয়েছে ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা ইসরা : ৩২)। যে সমাজে অশ্লীলতা ও ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে, সে সমাজ অশান্তি ও সব পাপাচারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। ইসলামে সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে কোনো প্রকার সৌন্দর্য বা ভালোবাসার প্রদর্শনী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। নারী জাতিকে লক্ষ করে মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘তোমরা জাহেলি যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বাইরে বের হয়ো না।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)। পুরুষ-মহিলা সবাইকে চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেনÑ ‘যে ব্যক্তি আমাকে তার মুখ ও লজ্জাস্থান হেফাজতের নিশ্চয়তা দেবে আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ (বোখারি : ৬১০৯)।
যৌবনের নিয়ন্ত্রণ কাম্য
যৌবন হচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত নেয়ামত। ৪০ বছরের পর যৌবনে ভাটা আসে। যৌবন পরবর্তী জীবন উপভোগ করতে চাইলে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও গোনাহের পথ থেকে দূরে থাকতে হবে। যৌন তাড়নায় অবৈধ ভালোবাসার চর্চা করা যাবে না। কারণ আল্লাহর আদালতে যৌবনের হিসাব দিতে হবে। এরশাদ হচ্ছেÑ ‘কেয়ামতের দিবসে কোনো মানুষ নিজের স্থান থেকে এক বিন্দুও সরতে পারবে না, যতক্ষণ না তার কাছ থেকে চারটি প্রশ্নের উত্তর নেওয়া হবে। ১. সে তার জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছে। ২. তার জ্ঞান কী কাজে ব্যবহার করেছে। ৩. তার ধনসম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে। আর ৪. তার যৌবনকে কীভাবে কাটিয়েছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।