মোঃ রাসেল হোসনে, ময়মনসিংহ : আজ ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল ময়মনসিংহ। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা শম্ভুগঞ্জ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে দলে দলে সার্কিট হাউজ মাঠে জমায়েত হতে থাকে। অবরুদ্ধ শহরবাসী এ খবর পেয়ে আনন্দ উল্লাসে রাস্তায় নেমে আসে। একদিকে বিজয় উল্লাস অন্যদিকে স্বজন হারানোর বেদনা সব মিলিয়ে দিনটি অত্যন্ত বেদনা বিধুর। তবে সর্বপোরি দিনটি ছিল অত্যন্ত খুশির, আনন্দের ও মুক্তির দিন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণের পর থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহকে দখলমুক্ত রেখে ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ২৩ এপ্রিল ময়মনসিংহের পতন ঘটলে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে স্থাপন করা হয় পাক হানাদার বাহিনীর বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার। হানাদারদের সহযোগী হিসাবে গড়ে তোলা হয় আলবদর আল সামস, রাজাকার বাহিনী। জেলা পরিষদ ডাক বাংলোটির “শান্তি ভবন” নাম দিয়ে টর্চার সেল ও কিলিং সেন্টার গড়ে তোলে। ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গড়ে তোলে আরও ২টি আস্তানা।
এছাড়াও অবাঙ্গালী বিহারিরা শহরের ছোট বাজারে গড়ে তোলে “কিলিং জোন”। ৭১ এ পাক সেনা আর রাজাকার, আল বদররা এসব আস্তানায় বাঙ্গালী নিধনে মেতে উঠে ছিল। প্রতিদিনের সেই নৃশংসতার নিদর্শন দেখা যেত ব্রহ্মপুত্রের চরে। মুক্তাগাছা, গৌরীপুর ও নান্দাইলের এইনৃশংসতার মাত্রা ছিল ভয়াবহ। প্রায় ৭ মাস পাক সেনাদের দখলে থাকার পর নভেম্বরের শেষের দিকে এক একদিন থেকে মুক্ত হতে থাকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলা। ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে নেত্রকোনা থেকে একটি গ্র“প অগ্রসর হয় ময়মনসিংহের দিকে।একই সময় হালুয়াঘাট, ফুলপুর হয়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক একটি দল অগ্রসর হয় শহরে অভিমুখে। ৯ই ডিসেম্বর রাতে ২টি দল অবস্থান নেয় ব্রহ্মপুত্রের ওপারে শম্ভুগঞ্জে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে শহরে কারফিউ জারী করে হানাদাররা।
অপরদিকে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। ১০ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিবাহীনীর নেতৃত্বে ছিলেন ঢালু যুব শিবির প্রধান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার সামস শিংহ বাবাজি। ১০ই ডিসেম্বর সার্কিট হাউজ মাঠে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন বর্তমান ধর্মমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মোঃ মতিউর রহমান। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার বাবাজির নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ থেকে হানাদার মুক্ত করেন। ১০ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহবাসীর জীবনে একটি অবিস্মরনীয় দিন হয়ে উঠে। স্বাধীনতার পরেও শহীদ পরিবারের কান্না আর দীর্ঘ শ্বাসে এখনো ভাড়ী হয়ে আছে ময়মনসিংহবাসীর হৃদয়ে। এই দিনটিকে স্মরণ করে রাখতে ১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস পালন করতে উদ্দোগ নেন। ঐ বছরই জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রবল ইচ্ছা ও দায়িত্বশীল ভুমিকার ফলে সামরিক আমলেও ১০ ডিসেম্বর মুক্ত দিবস পালন করতে সামর্থ হন। ছোট বাজার জিকেএমসি সাহা রোডে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কার্যালয়ে একদিনের একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ময়মনসিঙহ মুক্ত দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক সুচনা মুরু হয়। ১৯৮৩ সালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার সেলিম সাজ্জাদ জানান, ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস পালনে ১৯৮৩ সালে সামরিক শাসনামলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড উদ্দোগ নেয়।
সামরিক আমলেও তৎকালীন উপ আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক বিগ্রেডিয়ার সরদার মোঃ আলী হাসান, বিগ্রেডিয়ার এম শাখাওয়াত হোসেন, জেলা সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ কর্ণেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও জেলা প্রশাসক মোঃ আনসার আলী সিদ্দিকী সামরিক আইন বলবৎ থাকার পরও কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা না করায় আমরা ১০ ডিসেম্বর মুক্ত দিবস ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের পালন শুরু করতে পারি। এর পর থেকে প্রতি বছর প্রথমে এক দিন থেকে তিন দিন এবং পরে তিনদিন থেকে সাত দিনব্যাপী কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। যা বর্তমানে শহরের ছোট বাজার বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা স্মরণীতে পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও এদিনটি উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আয়োজনে সাতদিন ব্যাপী কর্মসূচী পালিত হবে।