অনলাইন ডেস্ক : আর দশজন দামাল ছেলের মতোই তিনিও স্বাধীন দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। সহযোগিতা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দাঁড়িয়েছেন নির্যাতিতদের পাশে।
অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কাগজের স্বীকৃতিটুকু পাননি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার আলোকদির বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডা. আবু তাহের মীর।
বিজয়ের মাসখানেক আগে হানাদারদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে প্রাণ হারান ফুলপুর আওয়ামী লীগের তৎকালীন এই সাধারণ সম্পাদক। তবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকায় নাম ওঠেনি তার।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সেই ত্যাগের স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কাজ হয়নি তার স্ত্রী মুর্শেদা বেগমের। এখন চেয়ে আছেন ভাগ্যের দিকে, অন্তত মৃত্যুর আগে যেনো স্বামীর স্বীকৃতিটুকু দেখে যেতে চান তিনি।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে সম্প্রতি এভাবেই বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবু তাহের মীরের স্ত্রী বয়োবৃদ্ধ মুর্শেদা।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অগ্রজ সৈনিক হিসেবে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন ডা. আবু তাহের মীর। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল মানবসেবা ও দেশসেবা।
কিন্তু দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী ফুলপুরের সূর্যসন্তান ডা. আবু তাহের মীর হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। এমনকি, তার নামটি পর্যন্ত নেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়।
জানা যায়, ফুলপুরের আলোকদি গ্রামের মজির উদিদন মীরের ছেলে ডা. আবু তাহের মীরের জন্ম ১৯২৬ সালের ৫ মার্চ। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবে ফতেহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। যোগলকিশোর উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমানে ফুলপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করেন।
এরপর তিনি জনমানুষের সেবার ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করে পল্লী চিকিৎসক (এলএমএএফ) হিসেবে। বেশ কিছুদিন তৎকালীন স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. লিয়াকত হোসেনের অধীনে প্র্যাকটিস করেন।
সেখান থেকে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে ডা. আবু তাহের ফুলপুর ছনকান্দা বাজারে তাহের মেডিকেল হল নামে একটি ডিসপেন্সারি খোলেন। অনেক চড়াই-উৎরাই শেষে এটি এলাকার মানুষের কাছে গরিবের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল লতিফ জানান, দেশ স্বাধীনের আগে তাহের হয়ে উঠেছিলেন এলাকার একজন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ চিকিৎসক। স্থানীয়দের রোগ-শোকের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে ওঠে তার চিকিৎসালয়। চিকিৎসার পাশাপাশি এলাকায় একজন সমাজসেবী হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। রাত নেই, দিন নেই যখনই কোনো মানুষের সমস্যার কথা শুনেছেন তখনই ছুটে গেছেন ফুলপুর ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত এলাকায়।
জানা যায়, গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের পরম বন্ধু আবু তাহের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মী হিসেবেও একাত্তরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছেন। একাত্তরে ফুলপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। এরপর পুরোদমে নেমে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে।
ফুলপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুল হেকিম সরকার বলেন, ডা. আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণদের নিয়ে ট্রেনিংয়ের জন্য হালুয়াঘাট সীমান্ত পার করে ভারতে দিয়ে আসতেন। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে যেতেন মুক্তিযোদ্ধারা। এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-দাবার দেওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।
‘তবে তার পরিবারের কেউ আসেনি; আমরাও ওভাবে বিষয়টি খেয়াল করিনি। তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নামটি যুক্ত হয়নি,’ বলেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র বলছে, ডা. আবু তাহের একজন শিক্ষানুরাগীও। ফুলপুর গার্লস হাইস্কুলের দাতা সদস্য ও ফুলপুর ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও এর পরিচালনা পর্ষদ ম্যানেজিং কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা জানিয়ে মুর্শেদা বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে আমার স্বামী (ডা. আবু তাহের) দলের পক্ষ থেকে সংগঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাকিস্তানি হায়েনারা ফুলপুর দখলের আগের দিনগুলোতে তিনি অস্ত্র হাতে সহযোগীদের সঙ্গে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দেন।
‘সেই সময় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। লুটপাটের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি রক্ষা করেছিলেন অনেক মা-বোনের সম্ভ্রম।’
তিনি জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ফুলপুর দখলের পর ডা. আবু তাহের বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। এপ্রিল মাসে তারা সপরিবারে ফুলপুর ছনকান্দা বাজারের বাসায় ওঠেন।
‘কিন্তু বাসা থেকে প্রায়ই তিনি (ডা. তাহের) উধাও হয়ে যেতেন। আমরা কোনো খোঁজ-খবর পাইতাম না। জিজ্ঞাসা করলেও কাউকে জানাতেন না। পরবর্তীতে শুনতে পেলাম- তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সঙ্গে কাজ করছেন।’
স্বামীর সেইসব দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আশির্ধ্বো মুর্শেদা। হত্যার সময় স্বামীর পরনের রক্তমাখা গেঞ্জিই তার একমাত্র স্মৃতি। যা নিয়ে প্রায়ই নাতি-নাতনিদের কাছে স্বামীর স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, যুদ্ধ চলাকালে এ কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে পড়েন আমার স্বামী। বেশ কিছুদিন কারাগারেও থাকতে হয় তাকে। জেলে থাকা অবস্থায় তার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। নির্যাতনে তার ছয়টি দাঁত ভেঙে যায়।
‘ওই সময় এলাকার হাজারো মানুষ পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের সামনে জড়ো হয়। এরপর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়। কয়েকদিন চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হন তিনি।’
তাই তখন বাসায়ই ছিলেন অসুস্থ ডা. আবু তাহের। নভেম্বর থেকেই চারদিকে পরাহত হচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। ওই সময়টায় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। তাই ১৫ নভেম্বর তার বাসায় রাজাকারদের সহায়তায় আক্রমণ চালায় হানাদাররা।
সেইদিনের স্মৃতি তুলে ধরে মুর্শেদা বেগম বলেন, ওইদিন রাতে প্রথমে বাসার দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকাররা। ব্যর্থ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দাঁড়ানো অবস্থায় আবু তাহেরকে গুলি করে তারা। এতে তার মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
আর এভাবেই একজন বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ডা. আবু তাহেরের মৃত্যুর পর তার ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন বিধবা স্ত্রী মুর্শেদা বেগম।
বললেন, স্বামীকে হত্যার পর আমাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালানো হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম কখন কিভাবে হয়েছে তা জানি না। কেউ পাশেও দাঁড়ায়নি। স্বামী হত্যার বিচার তো দূরের কথা মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি।
তবে তার আক্ষেপ দেশের জন্যে যে স্বামীকে হারাতে হলো সেই দেশে স্বীকৃতি মেলেনি। এখন তার একটাই চাওয়া- মৃত্যুর আগে স্বীকৃত ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় স্বামীর নামটি দেখে যেতে চান তিনি।
ডা. আবু তাহেরের ছেলে জাহিদুজ্জামান তুহিন বলেন, আমার বাবা একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছেন। অথচ আজ পর্যন্ত তার দলের কোনো নেতা, সংগঠন বা সরকার আমার ছেলে-মেয়ে কিংবা আমার কোনো খোঁজ নেয়নি। আমরা শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি চাই।