আমার হাতের তালুতে একটা দাগ আছে। দাগটা আমার একজন শিক্ষকের বেতের বাড়ির দাগ। সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৯৭/৯৮ সালের দিকে হবে। আমার এক সহপাঠিকে ঘুষি দিয়ে নাক ফাঁটিয়ে দেয়ার অপরাধে ঐ শিক্ষক দুইটা সন্ধিবেত আমার উপর ঝেড়েছিলেন। দুটা বেত ভাঙার পর উনি থেমেছিলেন। আমাকে পিটানোর পর যখন দেখলাম উনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন তখন বাইরে গিয়ে উনার জন্য চা, কেক,কলা আর পান নিয়ে এসে উনাকে দিয়েছিলাম। উনি খাবার গুলি খাচ্ছিলেন আর আমাকে দেখছিলেন। ক্লাস শেষে ফার্মেসী থেকে মলম এনে উনি আমার শরীরে নিজের হাতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। যখন মলম লাগাচ্ছিলেন তখন উনার চোঁখের কোণ চিক চিক করে উঠতে দেখেছি। এখন পর্যন্ত আমি আমার বাসায় এই কথা জানাইনি, কারণ আমি অপরাধ করেছিলাম, আমার শিক্ষক আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। শিক্ষকদের শাস্তি সব সময়ই শিক্ষার্থীদের জন্য আশির্বাদ। আমি এটাই বিশ্বাস করি।
গত ৩ ডিসেম্বর ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে ধরা পড়েন এবং পরে তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। যার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করে অরিত্রী অধিকারী। আর এটা নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে গিয়েছে। মানুষ এটা নিয়ে এতো বেশি বাড়াবাড়ি করছে যে মূল বিষয়টাই হারিয়ে যাচ্ছে।
কথায় আছে লেবু বেশি কচলালে তিতা হয়ে যায়। গত কয়েকদিন যাবত অরিত্রী অধিকারীকে নিয়ে যা হচ্ছে তা লেবুর তিতাকেও হার মানাতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হবেই, এই ঝগড়াটা ৩য় কোন ব্যাক্তির কানে যাওয়া নাকি শয়তানের কানে যাওয়া। শয়তান তখন আশেপাশের মানুষদের নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করে দেয় যেন শেষ পর্যন্ত তাদের বিবাহ বিচ্ছেদই ঘটে যায়। অরিত্রীর ব্যাপারটাও আমার কাছে এমনি মনে হচ্ছে। অরিত্রীর ব্যাপারটা এখন এমন একটা ইস্যু বনে গিয়েছে যে সেটা নিয়ে বেশ কয়েকটা পক্ষ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সরকারকে এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে। কারণ সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে সরকারের হেলমেট বাহিনীর কীর্তি ঢাকার জন্যই এই বাড়াবারি রকমের তৎপরতা বলে মনে করছে অনেকেই। অন্য দিকে স্কুলের বর্তমান ম্যানেজিং কমিটিকে ঘায়েল করে অন্য পক্ষ সুবিধা আদায় করার লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। আরেক দিকে সরকার বিরুধীরা এই ইস্যুটাকে ব্যাবহার করে সরকারকে চাপে ফেলতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অরিত্রীর আত্মহত্যাটা এখন লাভজনক ব্যাবসায় পরিনত হয়ে উঠছে।
আপনারা কি জানেন ? প্রতি বছর আমাদের দেশে কতশত শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে ? গত এক বছরে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আটজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয় থেকে ৭ জন আত্মহত্যা করেছে। তাহলে দেশের বাকি বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজ গুলির কি অবস্থা ? ভাবা যায় ? ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানেন ? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলিতে সকল শিক্ষার্থীদের টেবিল ফ্যান ব্যাবহার করতে হয়। কারণ হল গুলিতে সিলিং ফ্যান ঝুলানোর কোন ব্যাবস্থাই নেই। কেন নেই ? কারণ কোন শিক্ষার্থী যেন সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়তে না পারে। তার মানে কতৃপক্ষ ধরেই নিয়েছে সিলিং ফ্যান থাকলে ঝুলে পড়ার সম্ভবনা আছে।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আটজন অথবা নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলো এটা নিয়ে তেমন কোন হইচই দেখেছেন ? যেমনটা হচ্ছে অরিত্রীকে নিয়ে ? মূল কথা হলো, তারা কেন আত্মহত্যা করলো ? তাদের প্রায় প্রত্যেকের আত্মহত্যার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণটা থাকে শিক্ষক কতৃক ভৎসনা বা তিরস্কারের স্বিকার হয়ে। তাদেরকে কি পরিমান প্রেশারে রাখা হয় সেটা শুধুমাত্র তারাই জানে। দিন রাত এক করে এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে নিয়ে যাওয়ার পর ক্লাসে সকল শিক্ষার্থীদের সামনে যখন মুখের উপরে ছুরে মেরে যা ইচ্ছা তাই বলে অপমান করে (সকল শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়) তখন তারা প্রচন্ড ভাবে অপমানিত হয়। অপমানিত হতে হতে এক সময় নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আশা শুরু করে। এক সময় সকলের মাঝে থেকেও একা হয়ে যায়। এর পর থেকেই তাদের ভেতরে ডিপ্রেশনের দানা বাঁধা শুরু হয়ে যায় । যাদের সহ্য ক্ষমতা প্রবল তারা কোন না কোন ভাবে টিকে যায়, কেউ কেউ শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে পড়ে, কেউ কেউ ডিপ্রেশন দুর করার জন্য মাদকের পথ বেছে নেয়। আর যারা একেবারেই সহ্য করতে পারেনা তারাই আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়।
আত্মহত্যাই কি সমাধান ? কোন সুস্থ মানসিকতার মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেনা। প্রায় ২৭% থেকে ৯০% এরও বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে । এশিয়াতে, মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম । যারা আত্মহত্যার মাধ্যমে মারা যায় তাদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যে জটিল ডিপ্রেশন থাকতে পারে; এই বা অন্য কোনও মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যান্য অবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সিজোফ্রেনিয়া (১৪%), ব্যক্তিত্বের রোগ (৮%), দ্বিপক্ষীয় ব্যাধি, মোটা হওয়া জনিত ব্যাধি, এবং ট্রোমাউত্তর স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।
আত্মহত্যার জন্য একটা মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত করে ডিপ্রেশন। এই ডিপ্রেশনটা অনেক ভাবেই তৈরি হতে পারে। ৩০ বছরের উপরে যারা রয়েছে তাদের বেশির ভাগই পারিবারিক ঝামেলার কারণে ডিপ্রেশনে ভোগে। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিপ্রেশন তৈরি হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভুমিকা থাকে শিক্ষক কতৃক ভৎসনা বা তিরস্কারের স্বিকার হয়ে। দিনের পর দিন ভৎসনার স্বিকার হয়ে একজন শিক্ষার্থী ক্লাসের মধ্যে, বন্ধু মহলের মধ্যে এমনকি পরিবারের মধ্যে থেকেও একা হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সে অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়।
বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে যতটুকো শুনলাম তাতে করে আমি আতংক বোধ করছি। একজন খুব আক্ষেপ করে বললো, ভাই আমরা একটা আতংকের মধ্যে থাকি। ছাত্ররা পড়া না পারলে আমরা শাসনতো দুরের কথা ধমক দিতেও ভয় পাই। আপনিই বলেন, কোন শিক্ষার্থীর সাথে কি আমাদের ব্যাক্তিগত কোন শত্রুতা থাকে ? আমরা তাদের শাসন না করলে কে করবে ? আমরাতো তাদের ভালোর জন্য তাদের শাসন করতে চাই। যাতে করে তারা তাদের পড়াশোনাটা ঠিক ভাবে করে ভালো রেজাল্ট করে জীবনে ভালো কিছু হতে পারে। কিন্তু আমরা শিক্ষক সমাজ আজ অসহায়। চোঁখের সামনে একটা ছাত্র নষ্ট হয়ে যেতে দেখছি কিন্তু কিছুই বলতে পারছিনা।
এখন কথা হলো, এগুলি রোধে করণীয় কি হতে পারে ? যে শিক্ষক তাকে তিরস্কার করেছে তাকে শাস্তি দেয়া নাকি তাদেরকে সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা ? শিক্ষককে শাস্তি দিলেই কি সমাধান হয়ে যাবে ? না, হবেনা। সঠিক ও পরিপূর্ণ তদন্ত না করেই ঢালাও ভাবে শিক্ষকদের শাস্তি দিয়ে আমরা আমাদের বা আমাদের সন্তানদেরই ক্ষতি করছি। শিক্ষকের হাত যদি আমরা বেধে রাখি তাহলে আমাদের সন্তানকে ভালো আর মন্দের তফাত বুঝিয়ে মানুষ করবে কিভাবে ? কিছু কিছু শিক্ষকের জন্য সকল শিক্ষকদের হাত বেঁধে ফেলা কখনই কাম্য নয়।
অরিত্রীর আত্মহত্যার কথা শুনে প্রথমেই আমরা ঢালাও ভাবে শিক্ষকদের দোষী বলে ঘোষনা দিয়ে ফেলেছি। তদন্ত করে তার সহপাঠিদের সাথে কথা বলে সময় নিয়ে সঠিক স্বিদ্ধান্তে আসা যেত। কিন্তু আমরা কি করলাম ? শিক্ষিত জাতী গড়ার কারিগরদের এক দিনের মাথায় বহিস্কার করলাম। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে ওয়ারেন্ট জারি করে এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তারও করে ফেলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোট জামিন নামঞ্জুর করে উনাকে জেলেও পাঠিয়ে দিয়েছে। সুষ্ঠ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের হয়রানী বন্ধ করার ও আটক শিক্ষিকাকে জামিন দেয়ার অনুরোধ করছি।
এই ঘটনা থেকে দেশের শিক্ষার্থীরা কি মেসেজ পেলো ? আমরা পড়াশোনা করবোনা, পরিক্ষায় নকল করবো, ইচ্ছে হলে ক্লাস করবো না হলে নাই। কেউ আমাকে কিচ্ছু করতে পারবেনা। কোন শিক্ষক যদি কিছু করতে চায় তাহলে তাকেও জেলে ভরে দিবো। শিক্ষার্থীদের মন থেকে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা/সম্মান মুছে ফেলার ব্যাবস্থা করছি,আমরা নিজ হাতে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছি। একবার হলেও ভাবুন। আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে কোন পথে হাঁটছি।
কোন ধর্মেই আত্মহত্যার মতো জঘণ্য কাজকে সমর্থন করেনা। আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলি। অরিত্রীর পরিবারের জন্য অনেক অনেক সমবেদনা রইলো। একমাত্র ব্যার্থ মানুষরাই আত্মহত্যা করে। অরিত্রী আত্মহত্যা করে ব্যার্থতার পরিচয় দিয়ে গেলো। অরিত্রীর মতো ব্যার্থ হলে চলবেনা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সাধনার মাধ্যমে জীবনে সফল হতে হবে।
জাকারীয়া আহাম্মেদ খালিদ
লেখক ও সাংবাদিক।