ময়মনসিংহের ত্রিশালে গত ২৮ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। এর সব চেয়ে বড় প্রমাণ হলো ভোটের গরমিল । বিভিন্ন পত্রপত্রিকার ভাষ্য মতে ত্রিশাল ইউনিয়নের মত এমন কারচুপি সত্যই চোখে পড়ার মত। প্রদত্ত ভোটের সঙ্গে প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের সংখ্যার গরমিল তার বড় প্রমাণ। চেয়ারম্যান, সংরক্ষিত নারী সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদে মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা সমান থাকার কথা থাকলেও ১২টির মধ্যে ০৪টি কেন্দ্রের ফলাফলে তিন পদে ভোটের সংখ্যা তিন রকম। এই চার কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। বাকি আট কেন্দ্রে তিনি হেরেছেন। সেগুলোতে তিন পদে মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যায় গড়মিল হয়নি।
নির্বাচন-সংশ্নিষ্টদের মতে, বেপরোয়া কারচুপির কারণে এমনটি হয়েছে। সারাদেশে অনেক ইউনিয়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ত্রিশালের মতো এমন প্রমাণ রেখে কারচুপি হয়নি।
সমকালের করা ফল বিশ্নেষণে দেখা গেছে, সংরক্ষিত নারী সদস্য পদের চেয়ে চেয়ারম্যান পদে ৭৩২ ভোট বেশি পড়েছে। আর সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদের চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে ৭৯০টি। এমনকি চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী প্রার্থী একটি কেন্দ্রে প্রায় ৯৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন আরেক কেন্দ্রে।
ত্রিশাল ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগে’র প্রার্থী জাকির হোসাইন নৌকা প্রতীকে ০৬ হাজা’র ৯৭৭ ভোট পেয়ে বেসরকারি’ভাবে নির্বাচি’ত হয়েছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার সই করা ফলাফল অনুযায়ী, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান আনারস প্রতী’কে ০৬ হাজার ৯০৩ ভোট পেয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে’র আরও তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলে’ন। তাদে’র মধ্যে আনোয়া’র সাদত জাহাঙ্গী’র অটোরিকশা প্রতীকে পান ০৪ হাজার ৩০৩ ভোট এবং সাইদুর রহমান সবুজ চশমা প্রতীকে পান ০২ হাজার ২১১ ভোট। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদে’র মতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসাইনে’র চেয়ে বেশী ভোট পেয়েছেন। এমন ফলাফল প্রকাশের কারণ তারা আচ করতে পারলেও নিরব ভূমিকায় আছেন।
নৌকা’র নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. শাহাজাহান ভোটে’র ফল নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘যা হওয়া’র হয়েছে।’ তবে তার এ সহজ মেনে নেওয়া’র নাকি স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) রুহুল আমীন মাদানী’র ইশারায়। তিনি শাহজাহান’কে চুপ থাকতে বলেছেন এমনটাই খবর এসেছে ত্রিশালে’র রাজনৈতিক সূত্র থেকে (সমকালে প্রকাশ)।
পরাজিত প্রার্থীরা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি’র অভিযোগ তুলেছেন। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক মিয়া’র দাবি, ‘খুবই সুষ্ঠু ভোট হয়েছে।’ গরমিলে’র প্রশ্নে তার উত্তর হলো- কোনো কোনো ভোটা’র হয়তো ব্যালট বাক্সে না ফেলে বাড়ি নিয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন ‘গরমিলে’র এর জবাব দেওয়া আমার কাজ না। ফল দিয়ে দিয়েছি। কারও আপত্তি থাকলে আদালতে যাক।প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছিলেন ইবনে খালেদ বলেন, ভোটের ফলাফল রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। কোন পদে কত ভোট পড়েছে তা এখন মনে নেই। ‘(সমকালে প্রকাশ)সত্যই আমরা এক মজার দেশে বসবাস করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অস্বাভাবিক ভোট হয়েছে। দু-চারটি ব্যালট হারাতে পারে। কিন্তু ৭০০-৮০০ ব্যালট কমবেশি হওয়া অসম্ভব। কারচুপি হলে এমনটি হতে পারে।
ত্রিশাল ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৬১৮। রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত ফলাফল অনুযায়ী, চেয়ারম্যান পদে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ২১ হাজার ৩২৯। কিন্তু মহিলা মেম্বার পদে ২০ হাজার ৫৯৭ এবং মেম্বার পদে ২০ হাজার ৫৩৯।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ার সাদত জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, নৌকার প্রার্থী আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরেছে। তার পরও নৌকা হারত। প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে ভোটারদের। একটি কেন্দ্রে বিকেল ৪টার পর কয়েকশ ব্যালট কেটে বাক্সে ঢোকানো হয়েছে। এ কারণে চেয়ারম্যান পদে ভোট বেশি পড়েছে। সারাদিন রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।
আরেক প্রার্থী সাইদুর রহমান সবুজ বলেন, একজন ভোটারকে তিনটি পদের জন্য তিনটি পৃথক ব্যালেট দেওয়া হয়। ব্যালট না নেওয়ার সুযোগ নেই। ভোটার গোপন কক্ষে ভোট দিয়ে ব্যালট নির্ধারিত বাক্সে ফেলেন। ফলে তিন পদে ভোট সংখ্যা অবশ্যই সমান হবে। যদি কোনো পদের ব্যালট হারিয়ে যায়, তাহলে তা ফলাফলে উল্লেখ থাকবে। কিন্তু ফলাফলের কাগজে তা উল্লেখ নেই।
সাইদুর রহমানে’র আরও অভিযোগ, কারচুপির বিষয়ে দিনভ’র ভোট কর্মকর্তাদের জানিয়েও প্রতিকার পাননি। বরং ভোট কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন জালিয়াতিতে।
আওয়ামী লীগে’র বিদ্রোহী প্রার্থী সাইদুর রহমানে’র’ অভিযোগ, এমপি রুহুল আমীন মাদানীর প্রভাব খাটিয়ে কেন্দ্র দখল করেছেন নৌকা’র প্রার্থী।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রুহুল আমীন মাদানী বলেন,১১ নভেম্বরের পর তিনি কোথাও যাননি।প্রভাব বিস্তারের সুযোগও নেই,কেন্দ্রে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট ছিল।( সমকাল)
চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে চারটি কেন্দ্রে ভোট সংখ্যায় গরমিল সম্পর্কে রুহুল আমীন মাদানীর দাবি, স্থানীয় নির্বাচনে মাঝেমধ্যেই এমন হয়। আঞ্চলিকতার কারণে অনেক ভোটার মেম্বার পদে ভোট না দিয়ে ব্যালট নিয়ে চলে যায়। আর যে দুই কেন্দ্রে নৌকা ৯৬ এবং ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, সেগুলো আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা।
ফলাফল বিশ্নেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ভোট গরমিল হয়েছে ৫৫ নম্বর ছলিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের দুই হাজার ৯৬৯ ভোটের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে পড়েছে দুই হাজার ৫১২ ভোট। কিন্তু মহিলা মেম্বার পদে পড়েছে দুই হাজার ৩৪ ভোট। চেয়ারম্যান পদে এর চেয়ে ৪৭৮ ভোট বেশি পড়েছে। আর সাধারণ মেম্বার পদে দুই হাজার ৪১ ভোট পড়েছে; চেয়ারম্যান পদে এর চেয়ে ৪৭১ ভোট বেশি পড়েছে।
ছলিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে ২৭টি ভোট বাতিল এবং বৈধ ভোট সংখ্যা ০২ হাজার ৪৮৭। এর মধ্যে নৌকা পেয়েছে ০২ হাজার ৪০০ ভোট, যা প্রদত্ত বৈধ ভোটের ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আনারস প্রতীকে মাত্র ১০ ভোট পেয়েছেন। অপর তিন প্রার্থী যথাক্রমে ১৩, ০ ও ৬ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাকির হোসেন বলেন, ভোটাররা তাকে ভালোবাসে। সে কারণেই ৯৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
তবে স্থানীয় সংবাদ আর সাধারণ ভোটারদের দেয়া তথ্যমতে নৌকার যে প্রার্থী জাকির হোসেন তাকে অধিকাংশ ভোটাররা চিনতেননা নির্বাচনের আগে তার হঠাৎ আগমন যেন “আসলেন জয় করলেন” এরমত। আসলে নৌকা মার্কা তাকে পরিচিত করছে তার নিজের কোন জনপ্রিয়তা ইউনিয়নে তমন মেলেনি।তবে তার জয়টা রাজনৈতিক এক কৌশল এমনটাই দাবি বিভিন্ন মহলের।
প্রায় ৫০০ ভোট কী করে কম-বেশি হলো? যারা চেয়ারম্যান পদে ভোট দিয়েছেন, তাদের কি মেম্বার পদের ব্যালট দেওয়া হয়নি- এমন প্রশ্নে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যালট সবাইকে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো ভোট দিয়ে বাক্সে ফেলেনি।’ ব্যালট হারিয়ে গেছে কিনা- এ প্রশ্নে ইবনে খালেদ বলেন, ‘না।’ তাহলে কীভাবে গরমিল হলো- এর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ডায়াবেটিসের রোগী। খুব অসুস্থ। আর আপনিও তো বোঝেন।’
ছলিমপুর (পশ্চিম) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই হাজার ৭৫৬ ভোটের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে দুই হাজার ২৯৪ ভোট পড়েছে। মহিলা মেম্বার পদে ৪৩টি কম, অর্থাৎ দুই হাজার ২৫১ ভোট পড়েছে। আবার মেম্বার পদে দুই হাজার ২৩৬ জন ভোট দিয়েছেন।
এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা হারুন উর রশিদ কাঁঠাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি ভোটের ফল নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
ছলিমপুর (পশ্চিম) কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে দুই হাজার ২৮৪টি বৈধ ভোটের মধ্যে নৌকা পেয়েছে দুই হাজার ২৫৫টি। সে হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। যে আট কেন্দ্রে তিনি হেরেছেন, সেখানে তিনি ১৫ হাজার ৯৯৪ ভোটের মধ্যে মাত্র ৯৬১টি পেয়েছেন, যা ৮ শতাংশের কিছু বেশি।
চিকনা মনোহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে তিন হাজার ৫৭৯ ভোটারের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে দুই হাজার ৫৫৩ জন ভোট দিয়েছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া ফল অনুযায়ী, মহিলা মেম্বার পদে দুই হাজার ৪২০ জন ভোট দিয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে ১৩৩টি ভোট বেশি পড়েছে। মেম্বার পদে ভোট পড়েছে দুই হাজার ৫৩৫টি। এই কেন্দ্রে ৯১৫ ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছে নৌকা।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, তিন পদেই দুই হাজার ৫৩৫ ভোট পড়েছে। সেভাবেই তিনি ফল তৈরি করে পাঠিয়েছেন। এর বেশি জানা নেই।
চক পাঁচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে চেয়ারম্যান পদে দুই হাজার ১২৮ ভোটের এক হাজার ৬৬০টি পড়েছে। মহিলা মেম্বার পদে এক হাজার ৬২৫ এবং মেম্বার পদে এক হাজার ৬৫৩ ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রেও প্রথম হয়েছে নৌকা।
রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত ফল অনুযায়ী, চেয়ারম্যান পদে ২১ হাজার ৩২৯, মহিলা মেম্বার পদে ২০ হাজার ৫৯৭ এবং মেম্বার পদে ২০ হাজার ৫৩৯ ভোট পড়েছে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন সব সময় বলে অনিয়মের প্রমাণ পায় না। ত্রিশাল ইউনিয়নের ফলাফল বলছে কী পর্যায়ে কারচুপি হয়েছে। কমিশনের উচিত ফল স্থগিত রেখে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। এত বড় গরমিল তদন্ত না করা হলে দেশে একদিন নির্বাচন বলে কিছু থাকবে না।
তথ্য সূত্র-সমকাল