“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়” ১৯৫২সালে এভাবেই একটি মহল কেড়ে নিতে চেয়েছিল আমাদের মুখের ভাষা, চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল ভিন্ন ভাষার অসহ্য বোঝা, কিন্তু জাতী হিসেবে আমরা সাহসী, প্রতিবাদ আমাদের রগে রগে তাই পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রক্ত দিয়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের মুখের ভাষা।
পিচ্ছিলপথে অর্জিত এই ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, নিঃস্বংকোচে, নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারা বাংলা ভাষা, এই বাংলা ভাষা আবার আমাদের দেশীয় আঞ্চলিকতায় একেক অঞ্চলে একেকভাবে রূপ নিয়েছে যা অঞ্চলভেদে এবং আঞ্চলিক সাংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব অলংকার, যাতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে অঞ্চলের বাসিন্দার পরিচয়, আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্টী কিংবা একেক অঞ্চলে যা একেক টান কিংবা একেক উচ্চারণে মিশে গেছে একেক মাধুর্যতায়।
মূলত বিভিন্ন দেশের ভাষার বৈচিত্রের কারন ব্যাখা করা যতটা সহজ নয় তেমনি আঞ্চলিকতার বৈচিত্র ব্যাখা করাও কষ্টকর, বিশেষজ্ঞরা বলেন “প্রতি সাত মাইল দুরত্বে মানুষের ভাষা কিছুটা হলেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী” আর এভাবেই ক্রমশ দেশ, জাতী, গোষ্ঠী, বর্ণ, জাত ও জলপদের ভিন্নতায় ভাষার টান উচ্চারণ ও প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয়।
তেমনি ভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষাও এক আলাদা রূপ নিয়ে দীর্ঘকাল প্রকাশ হয়ে সেছে, যা আমাদের ময়মনসিংহের পরিচয় সুনাম খ্যাতির সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারাদেশ ব্যাপী, ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় যতটা আছে সৌন্দর্য ততটাই আছে মুগ্ধতা, উচ্চারণ কিংবা প্রকাশভঙ্গীমায় অন্য অঞ্চলের মানুষ সহজেই যেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না ঠিক তেমনি ময়মনসিংহের মানুষের মুখের উচ্চারণ টান থেকে অন্য অঞ্চলের মুখের উচ্চারণে মুগ্ধতা ছড়াবে না।
ভাষা বিশ্লেষকেরা ময়মনসিংহ অঞ্চলকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, পূর্ব ময়মনসিংহ এবং পশ্চিম ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর নিয়ে গঠিত পূর্ব ময়মনসিংহ, এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর নিয়ে গঠিত পশ্চিম ময়মনসিংহ।
বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ দুলাল তার বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান গ্রন্থে উল্লেখ করেন ভাষার বিবেচনায় নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ভাষা সিলেটের সাথে মিল আছে, আবার কিছু অংশ কুমিল্লা, নরসিংদী, ঢাকার সাথে মিল আছে, তেমনি টাঙ্গাইলের সাথ মিল আছে উত্তরবঙ্গের ও ঢাকার।
ময়মনসিংহের প্রবাদ, প্রবচন, লোকগান,লোকছড়া, ধাধা- শিলুক, ইত্যাদি ঘাটাঘাটি করলে কয়েক হাজার আঞ্চলিক শব্দ খুজে পাওয়া যায়, যা প্রতিনিয়ত ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাবহার হয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এসব শব্দের ব্যাবহার অত্যাধিক, তবে সব মিলিয়ে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা উচ্চারণ ও ব্যাবহারে কিছু বিষয় লক্ষণীয় যা হলো,
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় মহাপ্রাণ ধ্বনির উচ্চারণ না হয়ে স্বল্পপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারিত হয় যেমন ভাত>বাত, অভাব>অবাব, ঝড়>জর ইত্যাদি।
ময়মনসিংহের মানুষ শ,স,ষ, কে হ উচ্চারণ করে যেমন শালা>হালা, সাপ>হাপ, শুধুশুধু> হুদাহুদি, ষাড়>হার ইত্যাদি তবে কখনো হ কে অ কিংবা এ উচ্চারণ করে ডিমের হালি> ডিমের আলি, হনুমান>অনুমান, হঠাৎ >সটাৎ ইত্যাদি।
ময়মনসিংহের জামালপুর ও শেরপুর অঞ্চলের মানুষ র কে অ উচ্চারণ করে আবার র এর সাথে উ কার হলে উচ্চারণ করে রুউ যেমন রসুন>অসুন, রাজ্জাক>আজ্জাক।
টাঙ্গাইল অঞ্চলের মানুষ ল কে নিয়মিত ন উচ্চারণ করে বাক্য অনুযায়ী উদাহরণ হিসেবে “নাই দিয়া নাটিমাছ দিয়া নেটাপ্যকটা করছাল” এখানে লাটিমাছ>নাটিমাছ, লাউ>নাই, ল উচ্চারণে যেখানে ন উচ্চারিত হয়।
সাধারণ ময়মনসিংহর অঞ্চলে হ বর্ণের উচ্চারণে অ উচ্চারিত হয় তবে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের উচ্চারণে শব্দের শেষে অতিরিক্ত অ ব্যাবহার হয় যেমন হাস>আস, হাটাহাটি>আডাআডি, হালের বলদ> আলের বলদা, মামা হাটে গেছেন>মামা আডে গেছুইন ইত্যাদি, এছাড়াও এই অঞ্চলে স্বরবর্ণে ও এর উচ্চারণ উ হয় যেমন চোর>চুর, সোনা>সুনা, দোকান>দোহান ইত্যাদি।
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার বিশেষত্য হলো এর টান, ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণের বানান লিখা গেলেও উচ্চারণের যে টান তা কেবল শুনেই উপলব্ধি করা যায় যা আমরা কয়কটি বাক্য দেখলেই বুঝতে পারব,
“খা খা জলদি খেয়ে নে, খাবিনা তো এসেছিলি কেন?”> “কা কা জলদি কায়ালা, কাইত্যেনা ত্যে আইছিলি ক্যারে ত্যা?”
এভাবে আরো আছে যে “ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আসতে পারস না?” > ওইনো খারুইয়া রইসছ ক্যা? এফায় আবার পাশ না?”
“গোছলে সময় বিরক্ত করিস না ঘাটে চুপচাপ বসে থাক, আমি ডুব দিয়ে আসি” > গুছুলের সম ত্যাক্ত করিছ না, গাডঅ বইয়া খালি কইচ পারিস না, সিদা অইয়া ব,আমি ডুব দিয়া উডি”।
ভাষার এমন প্রবণতায় ময়মনসিংহবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাটা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে ততটা সহজ নয়, তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষা ততটাও কঠিন না যে পড়ে এবং শুনে যে কেউ বুঝবেনা বরং সহজেই যা পড়ে এবং শুনে বুঝে নেয়া সম্ভব, আমাদের দেশে প্রমিত ভাষার পাশাপাশি উপভাষার প্রচলন ব্যাপক, প্রতিটি অঞ্চলেই উপভাষা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছি কিন্তু উপভাষা মূলভাষার জন্য ক্ষতিকর না বিধায় উপভাষার চর্চা নিয়মিত লক্ষণীয় এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্যেও গ্রহণ করা হয় নানান উদ্যোগ।
মূলত ভাষার শক্তি তার শব্দ ভান্ডারে, এবং তার সৌন্দর্য চলৎশক্তিতে হঠাৎ এবং প্রতিটি ভাষার অবস্থান স্বাতন্ত্র তেমনি ময়মনসিংহে আঞ্চলিক ভাষার শক্তি তার বহুমাত্রিকতায়, যেমন বাংলা ভাষার লাথি শব্দটি ময়মনসিংহে ব্যাবহার হয় লাত্তি, ভ্যাদা, উষ্টা, মুড়া চারটি অর্থে এখানে লাত্তি বলতে সাধারণ অর্থে লাথি যা ফুটবলে দেওয়া হয়, ভ্যাদা অর্থে পায়ের তলা দিয়ে লাথি, উষ্টা অর্থে পায়ের তালুর অগ্রভাগ দিয়ে আঘাত, মুড়া অর্থে পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত সুতরাং বুঝা যায় ময়মনসিংহের ভাষায় বহুমাত্রিকতা বিদ্ধমান আছে এবং যার জন্যেই বাংলা ভাষায় ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা একটি স্থান দখল করে আছে।
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা শুধু মাত্র শব্দ বা বাক্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এতে আছে আঞ্চলিক ভাষার গান, কবিতা, ছড়া প্রবাদ, প্রচলন, নিম্মে আমি একেকে এসবের অংশভাগ উপস্থাপন করছি যাতে পাঠক ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নিতে পারে।
শব্দসম্ভার – এখন>অহন, বিষ্ময়কর > আচমকা, কচি >আবাত্তি, বাচ্চা >আবু, উপুর হওয়া > উন্দা, চন্দ্রগ্রহণ/সূর্যগ্রহণ > গন্না, গোবেচারা > গোবাইজ্জা, অস্থিরতা >ছইট, সন্তান জন্মের সাতদিন পর্যন্ত সময় > ছডি, তরকারি >ছালুন, থুথু >ছ্যাপ, পায়খানা > টাট্টি, কলাগাছ কিংবা নারিকেল ও সুপারি গাছের ডাল> ডাগগা, অসচেতন > তাবুদ্যা, ধানকাটা > দাওমারি, নাকের শ্লষ্মা >পেডা, অনুপস্থিত > বিগাইত, স্তন > বুনি, পেটের চর্বি > লুন্দি, তরকারির ঝোল > ছালুন ইত্যাদি বহু শব্দ ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাবহার করা হয়।
শব্দের মতময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় রয়েছে বহু গান, যা বিভিন্ন পালাপার্বণ ও
উৎসবে গাওয়া হয়, যেমন-
* আমরার আবু কান্দেরে
হউর বাড়ি যাইত,
আম দিতাম কাডল দিতাম
ফতফতাইয়া খাইত,
আবু হউর বাইত যাইত… ওওওও
এছাড়াও আরেকটি বিখ্যাত গান হলো-
*ওই যে গো দেহা যায় রেলের গাড়ি আইছে
রেলের কপাট খুঁইল্লা দেহি বাজান বইয়া রইছে
ও বাজান গো মাইয়া কিদুন আছে
তোমার মাইয়া কান্তে কান্তে দেউরি বাইংগা হালাইছে….
আঞ্চলিক ভাষায় এমন অনেক গানের পাশাপাশি রয়েছে অনেক ছড়া কবিতা –
* মুরগা নাচে মুরগি নাচে চালত ঠ্যাং থুইয়া
হউরি বউয়ে কাইজ্যা করে মাইট্টা উক্কা লইয়া.
* আদা পাদা ছিলুম দাদা
যে পাদ মিছা কথা কয়
তার পুটকিরে কুরাল বয়
কুড়ালে কয় ঠাইঠুই
হালা পাদ মারছস তুই.
এমন আরো মজাদার ও হাস্যরসের ছড়া ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়েছে, যা ময়মনসিংহের লোক ভাষা পরিচিতির এক অনন্য পথ হয়ে গড়ে উঠেছে, ছড়া কবিতাএ পাশাপাশি ময়মনসিংহের লোক ভাষায় রয়েছে বহু প্রবাদ যা মূলত গ্রামের কথাবার্তার ব্যাবহার হয়ে থাকে যেমন
“উল্যার আলাই বালাই সব বান্দরের গারত”
এছাড়াও
“আক্কলের খাইয়া মাডি
বাপে পুতে কামলা খাডি”
ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা জানাটা কেবল এই অঞ্চলের মূল জানাএ জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং বাংলা ভাষার কল্যাণের জন্যেও জুরুরি, তাই বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক সংস্কৃতি গবেষণা বিষয় প্রতিষ্টান জুরুরি যা ১৯৫২ সালের ভাষা অর্জনের উপভাষা ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাষাকেও আগলে রাখবে যত্ন সহকারে।
তথ্য সূত্র সহায়ক গ্রন্থ- ময়মনসিংহের লোকসংস্কৃতি সন্ধান।
শিক্ষার্থী, আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ময়মনসিংহ।