ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল : সাংবাদিকতায় আদর্শ, রাজনীতিতে প্রবাদ পুরুষ, সাহিত্যিক হিসেবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এবং পাশাপাশি আইন পেশায়ও সফলতার শীর্ষে – একজন ব্যাক্তিমানুষ এক জীবনে একাধারে এতো এতো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা শুধু কল্পনাতেই কল্পনা করতে পারেন!! কিন্তু এই সবগুলো সফলতাই যিনি একাধারে অর্জন করেছিলেন, যে কাজেই হাত দিয়েছেন, তার সবকিছুই সফলতার সঙ্গে করেছিলেন নিজের করতলগত, তিনি আমাদের সবার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব কিংবদন্তী আবুল মনসুর আহম্মেদ।
ইতিহাস খ্যাত এই মহান ব্যাক্তি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অন্তর্গত ধানীখোলা গ্রামের বিখ্যাত ফরাজী বংশে। তাঁর দাদার নাম আরমাল্লা ফরাজী, পিতার নাম আব্দুর রহিম ফরাজী এবং মাতার নাম মীর জাহান খাতুন। তিনি তাঁর বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। তাঁর আরও তিনজন ভাই ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসচেতন, জেদী এবং মেধাবী ছিলেন। সেসবের স্বাক্ষর তিনি আমৃত্যু আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন।
আবুল মনসুর আহম্মেদের পরিবার ছিলো ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তাঁর দাদার বড় ভাই আশেকউল্লাহ ফরাজী ছিলেন ওয়াহাবী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং বিখ্যাত তলোয়ার চালনাকারী। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামেই একটি মক্তবে। সেখানকার উস্তাদ ছিলেন তাঁরই চাচা মুনশী ছমিরদ্দিন ফরাজী। সেখানে তাঁর আরবী-ফারসী পড়ার পত্তন ঘটে। এরপর ১৯০৯ সালে ত্রিশালের দরিরামপুর মাইনর স্কুলে তিনি ক্লাস থ্রি তে ভর্তি হন। ১৯১১ সালে দিল্লীতে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দরবার উপলক্ষ্যে স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছাত্র হিসেবে তিনি অনেকগুলি ইংরেজী ও বাংলা বই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এরপর ১৯১২ সালে তিনি ময়মনসিংহ শহরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানেও ভর্তির পর তিনি পড়ালেখায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং ১৯১৭ সালে কৃতিত্বের সাথেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে পড়ার সময়েই তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। এরপর তিনি ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে এবং সেখান থেকে ১৯১৯ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন।
১৯২০-২১ সাল। সময়টা তখন পুরোপুরিই খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের। এ সময়তিনি ঢাকা কলেজে বি.এ-তে অধ্যয়নরত। উভয় আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন পূর্বক তিনি কলেজ বয়কট করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন। কিন্তু অধ্যাপক ল্যাংলির বিশেষ আদেশে তিনি বি.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ফলাফল না জেনেই গ্রামে ফিরে আসেন।
অসহযোগ আন্দোলনের একটি বিশেষ নীতি ছিলো,”ব্যাক টু ভিলেজ”। গ্রামে এসে তিনি আরেক কিংবদন্তী পুরুষ ও তাঁর বাল্যবন্ধু আবুল কালাম শামছুদ্দিন এর সাথে মিলে একটি পল্লী সমিতি করেন এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে হন এ স্কুলের অবৈতনিক হেডমাস্টার। পরবর্তীতে খেলাফত আন্দোলনে আরও ব্যাপক ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ময়মনসিংহ শহরে আসেন এবং তৎকালীন ন্যাশনাল স্কুলে চল্লিশ টাকা বেতনে মাস্টারীর চাকুরী নেন। খুব দ্রুতই তিনি ময়মনসিংহ জেলা খেলাফত কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হন। বছরকাল ঘুরতে না ঘুরতেই খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন উভয়ই স্তিমিত হয়ে আসে এবং তিনি মাস্টারী পেশায় আর মন ধরে রাখতে পারছিলেন না। ইতোমধ্যেই তিনি খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে ১৯২২ সালে কলকাতায় যান এবং সেখানে আবুল কালাম শামছুদ্দিনের সহায়তায় “মাসিক মোহাম্মদী” ও “সুলতান” পত্রিকায় লিখালিখি আরম্ভ করেন। এরই মাঝে আইন সভার নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয় এবং ময়মনসিংহ জেলা থেকে নির্বাচনে প্রার্থীতা করেন আবুল মনসুর আহম্মেদের নেতা তৈয়বুদ্দীন আহম্মেদ।
নির্বাচনে ধনবাড়ির বিখ্যাত জমিদার সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী ছিলেন তৈয়বুদ্দীন আহম্মেদের প্রতিদ্বন্দী। আবুল মনসুর ছোটবেলা থেকেই ছিলেন প্রজা আন্দোলনের সমর্থক। তিনি ময়মনসিংহে ফিরে এলেন এবং নবাব বাহাদুরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করলেন এবং “নবাব বাহাদুরের বাহাদুরী” শীর্ষক নির্বাচনী পুস্তিকা লিখলেন। নির্বাচনে নবাব সাহেব ধরাশায়ী হলেন এবং তৈয়বুদ্দীন আহম্মেদের বিজয়কে জনমানস থেকে শুরু করে নেতাকর্মীগণ সবাই একবাক্যে আবুল মনসুর আহম্মেদের কৃতিত্ব বলে স্বীকার করে নিলেন।
এরপর তিনি আবার কলকাতায় ফিরে গেলেন এবং আবুল কালাম শামছুদ্দীনের প্রচেষ্ঠায় “ছোলতান” পত্রিকায় প্রথমে ত্রিশ এবং পরবর্তীতে চল্লিশ টাকা বেতনে চাকুরী গ্রহন করেন। এ সময়তিনি দেশবন্ধুর গুণগ্রাহী হয়ে উঠেন এবং স্বরাজ দলের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত সমর্থকে পরিণত হন। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে সারা বাংলাতেই এক অনিশ্চয়তার দোল দেখা দেয়। এ সময় বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও দেখা দেয় ভয়ানকরূপে। এরপর তিনি প্রজা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন এবং একই সাথে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার কাজও করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস পার্টি একচোখাভাবে সব কাজে মুসলমানদের বিরোধিতা এবং স্বার্থবিরোধী কাজ করতে থাকায় তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন, কিন্তু পাশাপাশি কংগ্রেস সদস্যপদ তখনও ত্যাগ করেননি। এ সময়তিনি কংগ্রেসের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
কলকাতায় থাকা অবস্থাতেই তিনি তৎকালীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক মৌঃ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্য গড়ে তুলেন এবং মূলত তাঁর অনুরোধেই পুনরায় ময়মনসিংহ জেলায় ফিরে আসেন। এখানে তিনি ময়মনসিংহ জেলা শাখা মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে জেলা সভাপতি হন। পাশাপাশি তিনি একই জেলার আঞ্জুমানে ইসলামীয়ার সভাপতিও ছিলেন।
ময়মনসিংহে ফিরে এসে এবারে তিনি প্রজা সমিতির সংগঠনের দিকে মনযোগী হন এবং পাশাপাশি ময়মনসিংহ জজ কোর্টেও উকালতি আরম্ভ করেন। ইতোমধ্যেই তিনি কলকাতার “রিপন কলেজ” থেকে আইন শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯২৯ সালে বার কাউন্সিল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। ১৯২৯-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহে অবস্থান করেন এবং জজ কোর্টে প্র্যাক্টিস করেন। একই সাথে তিনি জেলার সংগঠন গুলো দক্ষতার সাথেই পরিচালনা করছিলেন। ইতোমধ্যে অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে প্রথম সংসদীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসলো এবং তিনি শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বিশেষ অনুরোধে মুসলিম লীগ ছেড়ে কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগদান করলেন। একই সাথে তিনি এই পার্টির জেলা সভাপতিরূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সমগ্র বাংলা জুড়ে নির্বাচনে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির মূল নীতি-নির্ধারকদের একজন ছিলেন এবং পার্টির নির্বাচনী ইশতেহার তাঁরই প্রস্তুতকৃত ছিলো। নির্বাচনে হক সাহেব জয়যুক্ত হন এবং কৃষক প্রজা পার্টি সরকার গঠন করে। তখন তিনি আবারও কলকাতায় ফিরে আসেন এবং কৃষক প্রজা পার্টির দৈনিক পত্রিকা ‘কৃষক’ এর সম্পাদক রূপে কাজ আরম্ভ করেন। এদিকে কৃষক প্রজা আন্দোলনে যোগদান করেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির জমিদার নবাব আলী চৌধুরীর ছেলে নবাবযাদা হাসান আলী চৌধুরী। তাঁর যোগদান পার্টির জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ময়মনসিংহ জেলা কমিটিতে আবুল মনসুর আহম্মেদ সভাপতিরূপে এবং নবাবজাদা হাসান আলী সাধারণ সম্পাদক রূপে কাজ করে যাচ্ছিলেন।
ময়মনসিংহে কৃষক প্রজা পার্টির কাজ তারা দুজনে একসঙ্গেই এগিয়ে নিচ্ছিলেন। পূর্বেই অত্যাচারী জমিদার রূপে প্রজা সাধারণের মাঝে পরিচিতি পাওয়া নবাব বাহাদুর আলী চৌধুরীর ছেলে বলে প্রথম দিকে নবাবযাদা হাসান আলী চৌধুরী কিছুটা অসুবিধায় পড়েছিলেন বটে কিন্তু আবুল মনসুরের অসাধারন বাগ্মিতায় তাঁর সে অজনপ্রিয়তা জনপ্রিয়তায় রূপ নিতে দেরী করেনি। দুজনে মিলে প্রজা আন্দোলনকে অনেকটা শক্তিশালী করেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে তিনি হক সাহেবের দৈনিক নবযুগ পত্রিকারও প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
আবুল মনসুর আহম্মেদ ব্যাক্তিজীবনে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর অগ্রজ শরতচন্দ্র বসুর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আবুল মনসুরের অনুরোধ রক্ষার্থেই অনেক দিনের তিক্ততা ভেঙে সুভাষবাবু গান্ধীজী ও জিন্নাহ সাহেবের সহিত দেখা করেছিলেন। ইতোমধ্যেই বাংলায় বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান, শেরে-ই-বাংলা থেকে স্যার নাজিমউদ্দিন হয়ে শহীদ সোহরাওয়র্দির মূখ্যমন্ত্রীত্ব, শেরে-বাংলার বিরোধী দলীয় নেতা হওয়া, শেখ মুজিবের মত ছাত্রনেতার উত্থান সহ ইত্যাদি ঘটনাবলী ঘটে।
আবুল মনসুর এ সময়শহীদ সোহরাওার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে উঠেন এবং মুসলিম লীগের ব্যানারে ১৯৪৬ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল আসন হতে জাতীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হোন। কিন্তু পরবর্তীতে জিন্নাহ সাহেবের নির্দেশে জাতীয় অধিবেশন বয়কট করেন। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী ছিলেন তিনি। তবে দেশভাগের পর তিনি অন্য অনেক বিশিষ্ট নেতার মত কলকাতায় কিছুদিন থেকে যান এবং সেখানে অবস্থানরত মুসলিম জনসাধারনকে সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে বাচানোর কাজে আত্মনিবেদন করেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর। কাগযের আদর্শ মাপ, চমৎকার সব লিখা, অসাধারণ সম্পাদকীয়, ক্ষুরধার মন্তব্য ইত্যাদি দিয়ে ইত্তেহাদ পত্রিকা তখনকার দিনে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সাংবাদিকতায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে আওয়ামীলীগ গঠিত হয়। ১৯৫০ সালে তিনি কলকাতা হতে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আইন ব্যাবসায় যোগ দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী সাহেব স্বয়ং ময়মনসিংহে তার বাসায় এসে তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করান এবং ময়মনসিংহ জেলায় আওয়ামীলীগ গঠন, প্রচার ও প্রসারনের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান। আবুল মনসুর আহম্মেদের নেতৃত্বেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে এবং তিনি নিজে হন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর সুপারিশেই সারাদেশে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতাদের পরিবর্তে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সভাপতি হবার সুযোগ পান এবং মুসলিম লীগের বিশালতা খর্ব হওয়া শুরু করে। এরই মাঝে ভাষা আন্দোলন তুমুলরূপে দেখা দেয়। তিনি এতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। এর আগেই তিনি ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে প্রথম লিখা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’ লিখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে নিজের সহমত পোষণ করেন। তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
এরপর তিনি আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে সেন্ট্রাল ভাইস প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রথম প্রাদেশিক ও জাতীয় ইলেকশনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টো তৈরীর দায়িত্ব তাঁর কাধেই বর্তায়। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারীর স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারকে একুশটি দফায়পরিণত করেন। নির্বাচনে তাঁর এই দফাগুলোকে কাজে লাগিয়েই যুক্তফ্রন্ট তুমোল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়। এ বিজয়কে ঐতিহাসিকগণ ব্যালট বিপ্লব বলেও আখ্যা দেন। আবুল মনসুর আহম্মেদ নিজে ত্রিশাল থেকে বিশাল ব্যাবধানে জয়ী হন এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দী সব প্রার্থীরই নির্বাচনী জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তাঁর বাল্যবন্ধু দৈনিজ আজাদ সম্পাদক কিংবদন্তী পুরুষ আবুল কালাম শামছুদ্দিন ছিলেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার মুসলিম লীগ প্রার্থী।
যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে কিছুদিনের মাঝেই যুক্তফ্রণ্টের শরীক দল গুলোর মাঝে বিরোধ দেখা দেয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান শেরে-ই-বাংলার নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনেন সংসদে। এ নিয়ে আওয়ামীলীগ ও অন্য শরীক দলগুলোর মাঝে বিরোধ চরমে উঠলেও আবুল মনসুর শেষ পর্যন্ত ঐক্য রক্ষার জন্য কাজ করেন।
১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ছয়দিন ওই দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এরই মাঝে কেন্দ্রে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে (১৯৫৬-৫৭) তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় কালেই তিনি এক সরকারী অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং পরে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সাথে তুমুল বাগবিতন্ডা ও বচসায় জড়িত হন এবং তখন থেকেই উভয়ের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনায় তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
এর কিছুদিন পরই সামরিক শাসন জারি করা হলে তিনি ইস্কান্দর মির্জা ও আইয়ুব খানের শাসনামলে বেশ কয়েকবার জেল খাটেন এবং ষাটের দশকের প্রথমভাগে রাজনীতি থেকে সক্রিয় অংশগ্রহন হতে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের বেলায় তিনি আমৃত্যু ছিলেন সক্রিয় কর্মী।
লাহোরে ১৯৬৬ সালে ৫-৬ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। অনেক জনপ্রিয়তা পাবার পাশাপাশি এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দলও গড়ে উঠে। মাওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান সহ অনেক বিশিষ্ট নেতাই এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চলে যান। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান আবুল মনসুর আহম্মেদের শরণাপন্ন হন। ছাপাখানার অপ্রতুলতার কারণে সেকালে প্রচার-প্রচারণা চলতো ছোট ছোট পুস্তিকার মাধ্যমে। আবুল মনসুর আহম্মেদ ছয় দফার সমর্থন পূর্বক একটি পুস্তিকা লিখে দেন এবং সপ্তাহান্তের মাঝেই ছয় দফার পক্ষে অভূতপূর্ব সমর্থন চলে আসে। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সময়ও তিনি ছিলেন বাঙালি নেতাদের অন্যতম উপদেষ্টা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আবুল মনসুর আহম্মেদের ঘনিষ্ঠ সহচর আতাউর রহমান খানের মতে –
“মনসুর ভাই পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক হরিঠাকুর হয়েছিলেন আমৃত্যু। ভুল তো তার হতেই পারে, আর দোলন যে তার প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য!’”
আবুল মনসুর আহম্মেদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও হাস্যরসাত্মক লেখক হিসেবেই তিনি সর্বসাধারণের কাছে সমধিক পরিচিত। সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন দিক বলা হয় ব্যাঙ্গ সাহিত্যকে আর এটাকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর লেখনীর প্রধান মাধ্যম হিসেবে। সাহিত্যের অন্যান্য আঙিনায়ও স্বাচ্ছন্দ্যে পদচারণা করেছেন তিনি। যে অঙ্গনেই তিনি কাজ করেছেন, সেখানেই শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ব্যঙ্গ-সাহিত্যে বলতে গেলে উভয় বাংলায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী। তাঁর প্রতিটি স্যাটায়ারই কালোত্তীর্ণ। সমাজপতি, ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী যেখানেই তিনি কোনো দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই তাঁর লেখনীর মাধ্যমে কশাঘাত করেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের রসাঘাত কশাঘাতে পরিণত হয়ে সমাজকে পরিশোধিত করত। এ আঘাত ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অবক্ষয়িত মূল্যবোধ আচার-অনুষ্ঠানকেই শুধু আক্রমণ করেনি, যারা এসব প্রসঙ্গ নিয়ে মিথ্যার জাল বুনে জীবনধারণ করতেন, তাদের তিনি নাস্তানাবুদ করেছেন। এসব রচনার পাঠকদের একদিকে যেমন মনে হবে, চরিত্রগুলো সবই খুব চেনা, তেমনি এদের কার্যকলাপও খুব পরিচিত। অনায়াসেই বলা যায়, আবুল মনসুর আহমদ সমকাল, সমাজ, জনগণ ও রাজনীতিসচেতন গল্পকার। সমাজের অতি কাছে ছিল তাঁর বসবাস। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হেঁটে চলায় নানা অনুঘটনা ভিড় করেছিল তাঁর অভিজ্ঞতার ডালিতে। আর খোলা চোখে দেখা ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্যকর্মে।
তাঁর “আয়না” গ্রন্থে ‘আয়নার ফ্রেম’ নামক ভূমিকায় জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন –
“এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়। কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপ মূর্তি মন্দিরে, মসজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিকসের আখড়ায়, সাহিত্য সমাজে বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।’
আবার খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন,
‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমেদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’
নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রত্যক্ষ ও উচ্চকিত হৃদ্যতা থাকা সত্ত্বেও আবুল মনসুর আহম্মেদ তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যটি উলেস্নখযোগ্য :
‘পরশুরাম হিন্দু দেবদেবী নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহস সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। আজ কোনো সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবেন কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। আবুল মনসুরের আক্রমণের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়, তাঁর বিদ্রোহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আয়না প্রকাশের এতকাল পরেও মনে হয়, এরকম একটি গ্রন্থের প্রয়োজন আজো সমাজে রয়ে গেছে।”
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন,
‘আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের স্যাটায়ার রচনার ক্ষেত্রে যে পূর্ব বাংলার পরশুরাম- এ সম্পর্কে বোধ করি কেউ দ্বিমত হবেন না।’
তিনি আরও বলেন,
‘দীর্ঘদিন তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এক সময় কেন্দ্রের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। পরিণত বয়সে নিজের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিকথা লিখেছেন, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। এই বইটির অনেক তথ্য অনেক ঘটনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, মতভেদ রয়েছে, নতুন ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু কেউ একথা অস্বীকার করেন না যে, এই বইটি পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সাহিত্যের বহুদিনের অভাব ভালোভাবে পূরণ করেছে।’
শুদ্ধ চিন্তার আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতা করেছেন, রাজনীতি করেছেন, ওকালতি করেছেন এবং সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এমন একজন মানুষ আবার সাহিত্যচর্চাও করেছেন। এজন্য তাঁকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আলাদা-আলাদাভাবে অন্তত তিনটি জীবনী লেখা দরকার বলে অনেকে মনে করেন যার একটি হবে সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে, একটি সাহিত্যিক হিসেবে এবং অপরটি রাজনীতিবিদ হিসেবে।
পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা সম্পর্কে একটা মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা আবুল মনসুর বলে গিয়েছেন। আমাদের এখনকার সম্পাদকদের এ-কথাগুলো কাজে লাগতে পারে। তাঁর মতে :
‘সম্পাদকীয় লিখিতে হইলে সম্পাদকদিগকে সব বিষয়ে ‘পন্ডিত’ হতে হয়। এঁরা সব ব্যাপারে সকলের স্বনিয়োজিত উপদেষ্টা। এঁরা জিন্না সাহেবকে রাজনীতি সম্বন্ধে, গান্ধীজীকে অহিংসা সম্বন্ধে, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রকে রসায়ন সম্বন্ধে, ডা. আনসারীকে চিকিৎসা সম্বন্ধে, হক সাহেবকে (এ কে ফজলুল হক) ওজারতি সম্বন্ধে, শহীদ সাহেবকে (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) দলীয় রাজনীতি সম্বন্ধে, মাওলানা আযাদকে ধর্ম সম্বন্ধে, এমনকি জেনারেল দ্য গলকে যুদ্ধনীতি ও স্টালিনকে কমিউনিজম সম্বন্ধে উপদেশ দিয়া থাকেন। সেই উপদেশ না মানিলে কষিয়া গালও তাঁদের দিয়া থাকেন। উপদেশ দেওয়া এঁদের কর্তব্য ও ডিউটি। সেজন্যই তাঁরা সম্পাদক। সেজন্যই ওঁদের বেতন দেওয়া হয়।’
তাঁর রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ব্যঙ্গরচনা- “আয়না (১৯৩৬-১৯৩৭)”, “ফুড কনফারেন্স (১৯৪৪)”, “গালিভারের সফরনামা”। স্মৃতিকথা- “আত্মকথা (১৯৭৮, আত্মজীবনী)”, “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (১৯৬৯)”, “শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু (১৯৭২)”। অন্যান্য রচনা- “সত্য মিথ্যা (১৯৫৩)”, “জীবনক্ষুধা (১৯৫৫)”, “আবে হায়াত (১৯৬৪)”, “হুযুর কেবলা”, “বাংলাদেশের কালচার” (১৯৬৬)”।
প্রতিভার দিক দিয়ে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে তিনি উলেস্নখযোগ্য অগ্রণী ভূমিকা রেখে গিয়েছেন, যা আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। ব্যাক্তিজীবনে আবুল মনসুর আহম্মেদ ছিলেন চার সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম আকিবুন্নেসা। তাঁর সন্তানদের মাঝে সকলেই উল্লেখযোগ্য কর্মে জড়িত ছিলেন বা রয়েছেন। তাঁর ছেলেদের মাঝে অন্যতম মরহুম মাহবুব আনাম ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ (প্রাক্তন সাংসদ) এবং বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তাঁর অন্য একজন ছেলে মতলুব আনাম ছিলেন একজন বিখ্যাত কলামিস্ট ও লেখক। তাঁর আরেক ছেলে মনজুর আনামও বিখ্যাত হয়ে আছেন সাংবাদিকতায়। তাঁর ছোট ছেলে মাহফুজ আনাম বিখ্যাত সাংবাদিক (বর্তমানে ডেইলী স্টার পত্রিকার সম্পাদক) ও সমাজ সেবামূলক নানান কাজে জড়িত। তাঁর নাতনী তাহমিমা আনামও বিশ্বখ্যাত লেখিকা।
সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য আবুল মনসুর আহম্মেদ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৭৯), নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পুরষ্কার লাভ করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ এই মহান কিংবদন্তী ব্যাক্তি ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান এবং বাংলাদেশ তথা সমগ্র উপমহাদেশ হারায় এক মহামূল্যবান রত্নকে। সমাপ্তি ঘটে একটি যুগের। তাঁর নামে ময়মনসিংহে একটি প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
১। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর
২।”আয়নার ফ্রেম‘-আয়না
৩। দুর্লভ কথক।। কালী ও কলম।। ইমরান মাহফুজ