বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক ব্যক্তি কর্তৃক প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ রকম নজির খুবই কম। তিনি নিজে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করে হস্তান্তর করে অন্য আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীর উদ্যোগ নিতেন।
অনেক বড় বড় কর্তা ব্যক্তি এ গুনী ব্যক্তির ছাত্র ছিলেন। তিনি যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নিতেন তখন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তা বাস্তবায়ন করে সফল হতেন। ময়মনসিংহের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ময়মনসিংহ জেলায় অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, ত্রিশাল নজরুল ডিগ্রী কলেজ, ত্রিশাল মহিলা ডিগ্রী কলেজ, আছিম কলেজ ও আহম্মদাবাদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ এ কে এম ইরফান আলী।
ত্রিশাল উপজেলা সদরে ও তার পিতৃভূমি বাগান গ্রামে তার প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে অন্তত ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের এ কৃতি শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ আলহাজ্ব ইরফান আলী যিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় আরফান স্যার নামে পরিচিত।
তিনি ১৯৩০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর মাতুলালয় চিকনা মনোহর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পৈত্রিক নিবাস ত্রিশালের বাগান গ্রামে। মাত্র ৬ মাস বয়সেই মাতৃহারা হয়ে এতিম হন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে চতুর্থ শ্রেনিতে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি নিয়ে উর্ত্তীন হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীন হন।
১৯৪৯ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে বৃত্তি নিয়ে আইএ পাশ করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাশ করেন। (উল্লেখ্য যে ঐ বছর কোন শিক্ষার্থীই প্রথম বিভাগে পাশ করেনি।) ১৯৫৬ সালে বিটি এবং ১৯৬১ সালে এমএ পাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
বিএ পাশ করার পরই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ইরফান স্যার শিক্ষকতা জীবনের প্রথমে যোগদান করেন ফুলবাড়ীয়া উপজেলার আছিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে। ১৯৫১ সাল হতে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করেন। এরপর ফুলপুর উপজেলার ফুলপুর ইন্সিটিটিউশনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন।
এর এক বছর পর ১৯৫৮ সালে শিক্ষায় অনগ্রসর নিজ উপজেলা ত্রিশালে এসে প্রতিষ্ঠা করেন কালীর বাজার উচ্চ বিদ্যালয় এবং সেখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুল জীবনের শিক্ষকতা শেষ করেন এবং ১৯৬৩ সালে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের প্রভাষক হিসেবে (বর্তমান সরকারী কলেজ) যোগদান করেন।
১৯৬৫ সালে সেখান থেকে আবার চলে যান নেত্রকোনা কলেজের প্রভাষক হিসাবে (বর্তমান সরকারী কলেজ)। এখানে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন। শিক্ষায় অনগ্রসর ত্রিশাল উপজেলায় তিনিই প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৭ সালে ত্রিশালে বিদ্রোহী কবির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠা করেন নজরুল কলেজ এবং অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন (যা বর্তমানে সরকারী কলেজ)।
এরপর কুলিয়ারচর গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কুলিয়ারচর কলেজ। সেখানে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ফুলবাড়ীয়া উপজেলাধীন সাহাব উদ্দিন মহাবিদ্যালয়, ত্রিশালের আহাম্মদাবাদ ও ত্রিশাল মহিলা ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষকতা জীবনের ইতি ঘটান ।
এছাড়াও তিনি নিজ গ্রামে বাগান ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, বাগান আজিজিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাগান বাগামারা আল মাদানী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মেধা, নিষ্ঠা, সততা, কর্মদক্ষতা দিয়ে তিনি নিজ কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তার জীবনের একটা বড় বৈশিষ্ট ছিল তিনি যে প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বা গড়েছিলেন তাকে মজবুত ভিতের উপর দাড় করিয়ে তিনি সেখান থেকে চলে গিয়েছেন আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল ছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ও মার্জিত স্বভাবের শিক্ষক। তিনি বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী ছিলেন যেমন- বাংলা, ইংরেজী, আরবী, উর্দু, হিন্দী। ইত্যাদি ভাষায় তিনি প্রভাবশালী ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক ।
জানা গেছে ত্রিশালে এমন পরিবার রয়েছ যেখানে দাদা, বাবা ও নাতি নাতনী সবাই তার ছাত্র ছিলেন। । তিনি ধর্মীয় কর্মকান্ডেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কোরআন শরীফের সাবলীল ব্যাখ্যাকারী হিসাবেও তিনি ছিলেন সর্বত্র পরিচিত। ২০১১ সালের ডিসেম্বর
মাসে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, ২ ছেলে, ৫ মেয়ে ও নাতি নাতনীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।