মোস্তফা কামাল : কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে এবার লড়াই হবে জমজমাট। এখানে বড় দুই দলের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন। একজন হলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ, অপরজন বিএনপি প্রার্থী সাবেক দু’বারের এমপি মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। এরা দু’জন আবার একই ইউনিয়নের, অর্থাৎ কটিয়াদী উপজেলার চান্দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা।
নূর মোহাম্মদের বাড়ি এ ইউনিয়নের মিরেরপাড়া গ্রামে, আর আখতারুজ্জামানের বাড়ি এ ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে। দু’জনের বাড়ির ব্যবধান প্রায় ৫ কিলোমিটার।
তবে এই আসনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাতবার চান্দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারাই এখানে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবারও এই আসনে অন্যান্য দলের আরো চারজন প্রার্থী থাকলেও মূলত লড়াই হবে নূর মোহাম্মদ এবং আখতারুজ্জামানের মধ্যে। আর এমপিও হবেন এদেরই একজন, এলাকাবাসীর এটা নিশ্চিত ধারণা।
এখানে অন্য প্রার্থীরা হলেন সিপিবির নূরুল ইসলাম, জাকের পার্টির মো. আব্দুল জব্বার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. সালাউদ্দিন রুবেল, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ প্রার্থী মীর আবু তৈয়ব মো. রেজাউল করিম এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির তারেক মো. শফিকুল ইসলাম।
২০০১ সালের ৮ম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আসনটি ছিল একমাত্র কটিয়াদী উপজেলা নিয়ে। তখন এখানে ইউনিয়ন ছিল ১০টি। এই আসনে ১৯৭০ ও ’৭৩ সনে এমপি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তিনি উত্তর চান্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বিএনপি থেকে এমপি হয়েছিলেন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের অনুজ সহোদর আনিসুজ্জামান খোকন। ১৯৮৬ ও ’৮৮ সালে এরশাদের শাসনামলে এমপি হয়েছিলেন জাতীয় পার্টি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া।
১৯৯১ সালে এমপি হয়েছিলেন তখনকার বিএনপির নবাগত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির এমপি হয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মুমুরদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান দয়াল। ১৯৯৬ সালের ৭ম সংসদ নির্বাচনে আবারো বিএনপি থেকে আখতারুজ্জামান এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০১ সালের ৮ম সংসদ ও ২০০৮ সালের ৯ম সংসদ নির্বাচনে এখানে এমপি নির্বাচিত হন কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা বিশিষ্ট স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত ডা. এমএ মান্নান।
তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ফলে কটিয়াদীর সঙ্গে পাকুন্দিয়া উপজেলাকে যুক্ত করা হয়। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে কটিয়াদী উপজেলায় ইউনিয়নের সংখ্যা হয় ১০টির স্থলে ৯টি। আর কটিয়াদী সদর ইউনিয়নটি পৌরসভায় উন্নীত হয়ে যায়। পাকুন্দিয়া উপজেলায়ও ১০টি ইউনিয়ন ছিল। ২০০৭ সালে এখানেও পাকুন্দিয়া সদর ইউনিয়নটিকে পৌরসভায় উন্নীত করা হলে ইউনিয়নের সংখ্যা হয় ৯টি।
২০১৪ সালের ১০ম সংসদ নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন পাকুন্দিয়া উপজেলার পাটুয়াভাঙ্গা ইউনিয়নের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন।
অর্থাৎ, ১৯৭০ সাল থেকে ১১টি সংসদের মধ্যে সাতটি সংসদেই কটিয়াদী উপজেলার চান্দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারাই এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবারো সেই সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে।
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ দীর্ঘদিনের চাকুরি ও কূটনীতিকের জীবনশেষে এবার এলাকার উন্নয়ন ভাবনায় নবীন মুখ হিসেবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। তবে আইজিপি হবার সুবাদে তিনি সারাদেশে একজন পরিচিত মুখ হলেও নিজ এলাকায় আইজিপি হবার অনেক আগে থেকেই তিনি বেশ পরিচিত এবং সজ্জন মানুষ হিসেবে সমাদৃত। তিনি গোটা এলাকায় একজন সদালাপী ও মিতভাষী হিসেবে পরিচিত। চমক লাগানো কথা বলে নিজের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা তার মধ্যে নেই বলে ভোটারদের মন্তব্য।
নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই নূর মোহাম্মদ দুই উপজেলায় গণসংযোগ, মতবিনিময় এবং সমাবেশ করে আসছিলেন। আর প্রতিটি কর্মসূচীই এলাকাবাসীর আর্থিক এবং সাংগঠনিক উদ্যোগে হয়েছে বলে জানা গেছে।
নূর মোহাম্মদকে ঘিরে কেবল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরাই নয়, সাধারণ এলাকাবাসী, এমনকি বিএনপির অনেক নেতাকর্মিও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী আখতারুজ্জামান ৫ম ও ৭ম সংসদে এমপি হলেও ৮ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. এমএ মান্নানের কাছে হেরে যান। এরপর অবশ্য তাকে আর দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপির লাগাতার সংসদ বয়কটের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করার কারণে সাংগঠনিক শৃংখলা ভঙ্গের দায়ে তাকে বহুদিন দল থেকে বহিষ্কার করে রাখা হয়েছিল।
যে কারণে ৯ম সংসদ নির্বাচনে তার পরিবর্তে তৎকালীন পাকুন্দিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইদ্রিছ আলী ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেয়া হয়। আর ১০ম সংসদ নির্বাচন তো বিএনপি বয়কটই করেছিল।
এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে আখতারুজ্জামানকে আবারো বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে। আখতারুজ্জামানও এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। তবে এই আসনে বিএনপির প্রচ- অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। এতদিন বিএনপির একটি অংশ নূর মোহাম্মদের পক্ষে কাজ করলেও এখন তাদের মধ্যে অনেকেই বিএনপির নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে ফিরে আসছেন বলে জানা গেছে। কাজেই বিএনপি এখানে কঠিন লড়াইয়ের আশা করছে।
সাবেক আইজিপির এক ধরনের ব্যক্তিগত ভাল ইমেজ রয়েছে। পাশাপাশি দলের মধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক ধরনের ঐক্যও তৈরি হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মিরা বিপুল ভোটে জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী।
এই আসনে মোট ভোটার আছেন ৪ লাখ ১৭ হাজার ২৬৫ জন। আগামী ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিনের ফয়সালার দিকে এখন সবার দৃষ্টি।