এমপির স্ত্রীর গাড়ি জব্দের নির্দেশ

ত্রিশাল প্রতিদিন ডেস্ক:: শনাক্ত হলেও দুদিনেও জব্দ হয়নি রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারে পথচারীকে চাপা দিয়ে হত্যা করা নোয়াখালী-৪ আসনের এমপির স্ত্রীর সেই গাড়িটি। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি—গাড়িটি জব্দ করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বলেছেন, গাড়িটি কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা ছিল, তারা সেটা শনাক্ত করেছেন। তবে গাড়িটি সেসময় কে চালাচ্ছিল, তা এখনও জানা যায়নি।
পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটির চালক কে ছিল, তা জানার জন্য ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও দুর্ঘটনার পর চালক গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে আসে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের ন্যাম ভবনের পাঁচ নম্বর ভবনের নিচে। সেখানকার সিসিটিভি’র ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার ঘটানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। গাড়িটি কে চালাচ্ছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে ওই গাড়িটি জব্দ করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। বৃহস্পতিবার (২১ জুন) সন্ধ্যায় খোঁজ নিয়ে
জানা গেছে, গাড়িটি এখনও জব্দ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১৯ জুন) রাতে মহাখালী ফ্লাইওভারে গাড়িচাপায় সেলিম বেপারী (৪৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। সেলিম নিজেও ছিলেন পেশায় একজন গাড়িচালক। তিনি নাখালপাড়ার জনৈক ইমরান নামে এক ব্যক্তির গাড়ি চালাতেন। মঙ্গলবার রাত পৌনে দশটার দিকে তিনি মালিকের বাসায় গাড়িটি রেখে উত্তরখানের নিজ বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। মহাখালী ফ্লাইওভারের কাছে বাসে ওঠার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এ অবস্থায় পেছন থেকে একটি প্রাইভেটকার তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা ওই গাড়িটির নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে গাড়ির মালিককে শনাক্ত করে পুলিশ।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রো গ-১৩-৭৬৫৫ সিরিয়ালের গাড়িটির মালিক কামরুন্নাহার শিউলী নামে এক নারী। তার স্বামী একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। কামরুন্নাহার শিউলি নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান।

দুর্ঘটনার পর ওই গাড়িটি ধাওয়া করে শামীম আশরাফী নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি জানিয়েছেন, ঘটনার পর মহাখালী থেকে চালক গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে গিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে ন্যাম ভবনের ভেতরে ঢোকে। গাড়িটিকে অনুসরণ করে তারাও ন্যাম ভবনের ভেতরে ঢোকেন। একই সময় এক মোটরসাইকেল আরোহীও ঘাতক গাড়িটিকে অনুসরণ করে ন্যাম ভবনে ঢুকে পড়ে। শামীম আশরাফী জানান, তারা ভেতরে ঢুকে দেখতে পান— আশেপাশের লোকজন গাড়ি থেকে নেমে আসা তরুণকে শাবাব নামে ডাকছে। শাবাব নামের ওই তরুণ হুমকি-ধমকি দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে থাকা মোবাইলের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ মুছে দেয়।

শামীম আশরাফী আরও জানান, ন্যাম ভবনে কিছুক্ষণ থাকার পর দায়িত্বরত আনসার ও কেয়ারটেকাররা তাদেরকে বের করে দেন। এসময় তরুণের পরিচয় জানতে চাইলে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও ওই তরুণকে শাবাব বলে জানান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শামীম আশরাফী বলেন, ‘এটি একটি অডি গাড়ি। আমি শতভাগ নিশ্চিত ওই তরুণ নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরী। সে নিজেও ন্যাম ভবনের ভেতরে এভাবেই পরিচয় দিচ্ছিল। তার গাড়িটিতে স্টিকার ছিল।’
এদিকে, ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমপি একরামুল করিম চৌধুরী ও তার স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলি দাবি করেন— দুর্ঘটনার সময় তাদের সন্তান গাড়িতে ছিলেন না। নূর আলম নামে এক চালক গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমার ছেলে গাড়ি চালায়-ই নাই। চালাইছে আমার ড্রাইভার। এখন এক্সিডেন্ট করছে। এক্সিডেন্ট তো এক্সিডেন্টই। পুলিশ তদন্ত করতেছে। আমার পাঁচ-ছয়টা ড্রাইভার। সবাই তো ছুটিতে গেছিল। আমি নোয়াখালীতে, এখন কোনটা (ড্রাইভার) আইসা ডিউটি করতেছে, বলতে পারতেছি না।’

ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজছেন তদন্ত কর্মকর্তা

দুর্ঘটনার পর চালক গাড়িটি নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে ন্যাম ভবনের ভেতরে পাঁচ নম্বর বিল্ডিংয়ের নিচে গিয়ে থেমেছে। এই দৃশ্য দুই প্রত্যক্ষদর্শী দেখেছেন। দুর্ঘটনার পর একজন মোটরবাইক নিয়ে এবং আরেকজন প্রাইভেটকার নিয়ে ওই গাড়িটির পিছু নেন। দুর্ঘটনার রাতেই তারা পুলিশের কাছেও এসব তথ্য জানিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ সেসব বিষয় আমলে না নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ খুঁজছে। ন্যাম ভবনের প্রধান ফটকসহ ভেতরে থাকা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে আগ্রহ নেই পুলিশের।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ন্যাম ভবনের পাঁচ নম্বর বিল্ডিংয়ে গেলে এবিষয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, দুর্ঘটনার রাতেই এখান থেকে এমপি সাহেবের লোকজন গাড়িটি নিয়ে চলে গেছে। আর এই বাসায় চালক-কর্মচারীরা থাকতো। তারাও ঘটনার পর কেউ আর আসেনি। এই প্রতিবেদক নিজেও ওই ভবনের গ্যারেজে সেলিম ব্যাপারীকে চাপা দেওয়া সেই গাড়িটির খোঁজ করেন।কিন্তু সেখানে গাড়িটি ছিল না।

যোগাযোগ করা হলে পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সৈয়দ মামুন মোস্তফা বলেন, ‘গাড়িটি কার তা আমরা কনফার্ম হয়েছি। গাড়িটি কে চালাচ্ছিল তা জানার চেষ্টা করছি। এজন্য ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।’ ন্যাম ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ন্যাম ভবনের ফুটেজ সংগ্রহ হবে দ্বিতীয় স্টেপে। যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেখানকার ফুটেজ আমাদের বেশি প্রয়োজন।’ গাড়িটি জব্দ করা প্রসঙ্গে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গাড়িটি জব্দ করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যখন ইচ্ছা তখনই জব্দ করতে পারবো। কিন্তু তার আগে কে গাড়িটি চালাচ্ছিল, তা জানার চেষ্টা করছি।’

গাড়ির চালক ও মালিকের সঙ্গেও কথা বলেনি পুলিশ

দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িটির চালক ও মালিকের সঙ্গে এখনও কথা বলেনি পুলিশ। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই সুজন চন্দ্র কর্মকার ও ওসি শিকদার শামীম হোসেন এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে।

যোগাযোগ করা হলে এ মামলার বাদী ও নিহত সেলিম ব্যাপারীর মেয়ের জামাই আরিফ হোসেন ভূইয়া জানান, দুর্ঘটনার পর থেকে থানা ও হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি এবং লাশ নিয়ে দাফন করার পর তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মামলার পর পুলিশ বা এমপির পরিবার থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।