বর্তমান যুগে শারীরিক অসুস্থতার সাথে সাথে যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠছে, তা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। WHO এর সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রতি চারজনের একজন তার জীবনের কোনো না কোনো সময়ে যেকোনো মানসিক সমস্যার শিকার হয়ে থাকেন এবং বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ শিশু কিশোরেরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এগুলো তো গেলো হিসাবের কথা, মানসিক রোগের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক এবং একই সাথে ভয়ানক দিকটি হচ্ছে এর বিচিত্রতা। এমন কিছু অদ্ভুত মানসিক রোগ রয়েছে, যার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, যাদের বাস্তবতা হলিউডের হরর মুভিগুলোকেও হার মানায়। আর আজকের আমাদের এই আয়োজন তেমনি কিছু অদ্ভুতুড়ে মানসিক রোগ নিয়ে।
১। এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম
এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম একটি বিরল ও অদ্ভুত মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি তার যেকোনো একটি হাতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে দেখে মনে হয় হাতটি তার নিজের না বা হাতটির ভেতর সম্পূর্ণ অশরীরী কিছু এসে ভর করেছে। এ অবস্থায় দেখা যায় ব্যাক্তিটি তার নিজের বা অন্য কারো গলা চেপে ধরেছে, বা নিজেকে বা অন্য কাউকে আচড়ে, খামচি দিয়ে বা মেরে রক্তাক্ত করে ফেলছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আলঝেইমার বা ক্রুজফেল্ড-জেকব রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে কোন অস্ত্রপাচারের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও এই রোগ দেখা যেতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, এই রোগটির এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর চিকিৎসা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। যারা যারা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তারা আক্রান্ত হাতটিকে কোনো না কোনো কাজে ব্যাস্ত রেখে বা অন্য হাতটি দিয়ে আক্রান্ত হাতটিকে ধরে-বেঁধে রেখে কিছুটা রেহাই পেয়ে থাকে।
২। অ্যাপটেমনোফিলিয়া
অ্যাপটেমনেফিলিয়াকে অনেকসময় ‘বডি ইন্টেগ্রিটি ডিসঅর্ডার’ বা ‘অ্যামপিউটি আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার’ ও বলা হয়। এটি একটি ভয়ানক মানসিক সমস্যা, যার ফলে আক্রান্ত ব্যাক্তিটির সর্বদা নিজের সুস্থসবল অঙ্গগুলোকে কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। এই ভয়ানক অসুখটি সম্পর্কে এখনো তেমন বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, মস্তিষ্কের ডান প্যারাইটাল লোবে কোনো আঘাত বা সংক্রমণের সাথে এই রোগটির সম্পর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ ডাক্তারই কোনো কারণ ছাড়া শুধুমাত্র কারো ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে তার সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে দিতে রাজি হবেন না। এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী নিজেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটা শুরু করে, যা আরো ভয়ানক। এভাবে হাত-পা কেটে ফেলে দেবার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের মাঝে এ নিয়ে কোনো অনুতাপ দেখা যায় না। বরঞ্চ এ বিষয়ে তাদের বেশ খুশিই দেখা যায়!
৩। বোয়ানথ্রপি
এরকমই আরেকটি বিরল ও উদ্ভট মানসিক রোগ হচ্ছে বোয়ানথ্রপি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি নিজেকে গরু মনে করে এবং গরুর মতো আচরণ করতে থাকে! অনেক সময় তারা গরুর পালের সাথে মাঠে চলে যায় এবং তাদের সাথে চার পায়ে হাঁটতে থাকে আবার অনেককে গরুদের সাথে ঘাস চিবুতেও দেখা যায়! বোয়ানথ্রপি আক্রান্ত রোগীরা বুঝতে পারে না তারা কখন কীভাবে কিংবা কেন এই ধরনের কাজ করছে। যখন তারা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তখন তারা তাদের এই অস্বাভাবিকতার কথা মনে করতে পারে না। বর্তমানে মানসিক চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, এই রোগটি হিপনোটিজম বা কোনো স্বপ্ন দেখার মাধ্যমে হয়ে থাকে। আশ্চর্যজনকভাবে এই বোয়ানথ্রপি রোগটির বর্ণনা উঠে এসেছে বাইবেলে। সেখানে রাজা নেবুচাঁদনেজারের বর্ণনা দেওয়া হয় এভাবে, “মানুষ থেকে বিতাড়িত হয়ে সে ষাঁড়দের সাথে ষাঁড় হিসেবে ঘাস খেতে থাকে।”
৪। ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি
ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি আর বোয়ানথ্রপির মাঝে কিছুটা মিল থাকলেও রোগ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। এক্ষেত্রে রোগী মনে করে থাকে সে কোনো প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে যেমন, নেকড়ে, শিয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী। আর একে সে নিজের একধরনের ক্ষমতা বলে মনে করে। এই বিশ্বাসের সাথে সাথে একসময় সে ওই প্রাণীর মতো আচরণ করতে শুরু করে। রোগ চরম পর্যায়ে চলে গেলে একটা সময় তাদের বনে জঙ্গলে পালিয়ে থাকতে দেখা যায়। এই রোগটির সাথে উপকথার ওয়ার উলফের কাহিনীর বেশ মিল পাওয়া যায়, যদিও এখানে ব্যক্তিটি সত্যিকার অর্থে শারীরিকভাবে রূপান্তরিত হয় না, সম্পূর্ণটাই তার মস্তিষ্কের বিভ্রম।
৫। কোটার্ড ডিল্যুসন
কোটার্ড ডিল্যুসনকে অনেকে ‘ওয়াকিং ডেড সিনড্রোম’ ও বলে থাকে। বর্তমানের ‘জম্বি ট্রেন্ড’ এর সাথে এই রোগটির বেশ মিল পাওয়া যায়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে হাঁটতে পারা মৃত মানুষ বা ভূত বলে মনে করে। তারা মনে করে তাদের দেহের সব রক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের দেহের ভেতর কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। তাদের মনে হতে থাকে যে তাদের শরীরটি পঁচে গেছে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা ভয়ংকর রকমের হতাশায় ভুগতে থাকে এবং কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই ভ্রান্তির কারণে না খেতে খেতে এক পর্যায়ে তারা অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। এই ভয়াবহ রোগটি ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম স্নায়ু চিকিৎসক কোটার্ড আবিষ্কার করেন। তবে আশার বিষয়টি হচ্ছে এই কোটার্ড ডিল্যুসন রোগটি যথেষ্ট বিরল। এর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনাটি দেখা যায় হাইতিতে, সেখানে একজন ব্যাক্তি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে বসেছিলেন তিনি মারা গেছেন এবং বর্তমানে নরকে আছেন!
৬। ডিওজেনেস সিনড্রোম
ডিওজেনেস সিনড্রোম আরেকটি অদ্ভুত মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির মাঝে সবকিছু জমিয়ে রাখার একটি অসুস্থ প্রবণতা দেখা যায়, তারা সবকিছু জমিয়ে রাখতে চায় এবং পুরোনো কিছু ফেলতে চায় না। অনেকসময় তাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জিনিষ কুড়িয়ে আনতেও দেখা যায়। এই রোগটির নাম গ্রিক দার্শনিক ডিওজেনেস অফ সিনপির নাম অনুসারে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই রোগে বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে একা বাস করছে। আমেরিকার একটি সমীক্ষায় দেখা ৬০ বছরের উপরে ০.০৫ শতাংশ আমেরিকান এই রোগটিতে আক্রান্ত। ডিওজেনেস সিনড্রোম দু ধরনের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে প্রাইমারি, যা হলো ব্যক্তিটির নিজে থেকেই এই রোগটি রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে সেকেন্ডারি, এই ক্ষেত্রে রোগটি অন্য কোনো মানসিক রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিটি প্রচণ্ড খিটখিটে স্বভাবের হয়ে পড়ে, তারা প্রচণ্ড অস্বাস্থ্যকর ও অপরিছন্ন পরিবেশে বসবাস করে থাকে। তারা নিজেরা নিজেদের খেয়াল রাখে না এবং অন্যদের সাহায্য নিতেও পছন্দ করে না। মানসিক চিকিৎসকেরা বলে থাকেন দীর্ঘদিন একা থাকার ফলে বা একটি সুন্দর পারিবারিক পরিবেশের অভাবেই মূলত এই রোগটি হয়ে থাকে।
৭। ফ্যাক্টিটিয়াস ডিসঅর্ডার
ফ্যাক্টিটিয়াস ডিসঅর্ডার এমন একটি মানসিক রোগ, যার ফলে একজন ব্যাক্তির মাঝে বারবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নেবার ইচ্ছা কাজ করে! এমনকি তারা চিকিৎসা নেবার জন্য অনেকসময় ইচ্ছা করে নিজেকে অসুস্থ করে তোলে। আবার অনেক সময় তারা হাসপাতালে যাবার জন্য অসুস্থতার ভান করে, মিথ্যা বলতে থাকে। এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মেডিকেল টার্মগুলোর উপর বেশ ভালো জ্ঞান থাকতে দেখা যায়। তাই তারা সহজেই কোনো না কোনো রোগের ভান ধরতে পারে। তারা তাদের পরিবারের লোকদের চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে দিতে পছন্দ করে না এবং সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ কোনো অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। এদের রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসা নেবার জন্য এরা নিজেদের যেকোনো ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারে, যা অনেকসময় তাদের মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দিতে পারে। ফ্যাক্টিটিয়াস ডিসঅর্ডারের মূল কারণ মনোবিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা। তবে শৈশবের কোন শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা এবং প্রচণ্ড মানসিক আঘাতকে রোগটির রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৮। ক্লুভার-বুসি সিন্ড্রোম
আরেকটি ভয়ানক ও অস্বাভাবিক মানসিক রোগ হচ্ছে ক্লুভার-বুসি সিনড্রোম। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মাঝে বিভিন্ন অখাদ্য খাবার জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছা কাজ করে এবং বিভিন্ন জড় পদার্থের প্রতি তারা যৌন আকর্ষণ অনুভব করে থাকে। যেমন এদের মধ্যে অনেকে বই-খাতা, কলম, মাটি ইত্যাদি অখাদ্য খেয়ে থাকে। আবার অনেকে গাড়ি, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইত্যাদির সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে থাকে। ফলস্বরূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ক্ষতি করে বসে। বলা বাহুল্য, এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা বিভিন্ন বস্তু এবং ব্যক্তিকে সহজে সনাক্ত করতে পারে না এবং তাদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল থাকে। স্নায়ুচিকিৎসকদের মতে, মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোবে কোন আঘাত বা সংক্রমণের ফলে এই রোগটি হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, এই রোগটির কোনো চিকিৎসা নেই, আক্রান্ত ব্যক্তির আজীবন রোগটি বয়ে বেড়াতে হয়। তথ্যসূত্র: রোয়ার বাংলা।