সামাজিক নিয়মনীতির বাইরে লিভ টুগেদার বাড়ছে বাংলাদেশে

লিভ টুগেদার যা পশ্চিমা সমাজে প্রচলীত একটি নাম। দু’টি মানুষে মধ্যে ভাল লাগা বা মনের মিল বা একই মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার হলেই একসাথে থাকার নাম লিভ টুগেদার । দীর্ঘদিন ধরে লিভ টুগেদার ছিল ইউরোপ ,আমেরিকা তার পর মধ্যপ্রাচ্য এখন এশিয়া এর বিস্তার দ্রুত বেড়ে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে এটি চলে খুব গোপনে কারণ এখানে হারাম বলে কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত ভারত,পাকিস্থান,নেপাল,বাংলাদেশ,ফিলিপিন,শ্রীলংকা থেকে আসা মানুষের বসবাস বেশী। কাজের সুবাদে একে অপরের সাথে পরিচয় হয়। তবে সবাই নয় তার মধ্যে ভারতীয় ও ফিলিপিন ,নেপাল ও বাংলাদেশীরা এগিয়ে আছে। এখানে বাসা ভাড়া বাচাতে নিজেকে স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করাটা মূল বিষয়। মূলত জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিভ টুগেদার করেন।

প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম নেয়া,সামাজিক নিয়মনীতির বাইরে চলাফেরা করেছে এমন মানুষেরা বেশী এ সম্পর্কে আবদ্ধ। যেভাবে চললে নিজের কাছে ভালো লাগবে সেটাকেই প্রাধান্য দেয় এরা বেশি। লিভ টুগেদার তাদের কাছে একটা স্বাভাবিক বিষয়। ভালো বন্ধু, ভালো প্রেমিক বলেই বেশী পরিচিত তারা । ফেসবুক ও অনলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে শুরু বা পরিচিত হয়।

লিভ টুগেদারে মূলত ভাড়া বাসা পেতে বেগ পেতে হয় না ,একজন আরেকজনের পাশে থাকা। অসুস্থ হলে সেবা করা, রান্না করা, খাবার খাওয়া একসঙ্গে থাকা নিজের চাহিদা পূরণের পাশা পাশি প্রয়োজন শেষে যার যার পথ বেছে না। আসলে লিভ টুগেদার মানে যে ভিন্ন কিছু এমনটা নয়। লিভ টুগেদারে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমনটি পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাভাবিক। এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা মানুষ গুলো আজীবন এভাবেই থাকবো এমনটা আশা করে।

একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ঢাকায় চাকরিরত নিথিতা বলেন, অহরহ মানুষ তার প্রয়োজনে লিভ টুগেদার করছে। আমি অন্তত শতাধিক জুটিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। কারণ যেকোনো সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাই মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে আইনি জটিলতা ও টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবেও নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা দায়িত্ব থাকে। পারিবারিক-সামাজিক নানা বিষয় মেনে চলতে হয়।

সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ শুধুমাত্র তাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিভ টুগেদার করেন। এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। আবার কেউ কেউ বিয়ের আগে নিজেদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার জন্য করেন।

লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক ও আইনি বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ যারা লিভ টুগেদার করেন তাদের মধ্যে সব সময় ধরা পড়ার একটা ভয় কাজ করে। বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি থানা পুলিশের ভয় কাজ করে। বাসা ভাড়া পেতে বেগ পেতে হয়। বাসা পেলেও চড়া দামে ভাড়া দিতে হয়। ভাড়া নিলেও ভাড়াটিয়ার তথ্য পুলিশের কাছে জমা নিয়েও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। সঠিক তথ্য পুলিশকে দিতে অনেকে গড়িমসি করেন। বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। অনেকে আবার ভুয়া বিয়ের কাবিননামা তৈরি করে রাখেন। এ ছাড়া বাড়ির মালিক অভিভাবকের মোবাইল নম্বর চাইলে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের নম্বর দিয়ে বুঝ দিতে হয়।

পুরাণ ঢাকার এক তরুণ ও চাঁদপুরের এক তরুণী  একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সূত্রেই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। ওই তরুণী থাকতেন একটি মহিলা হোস্টেলে। আর তরুণ তার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসতেন। কিছুদিন পর ওই তরুণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর পুরাণ ঢাকার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসবেন পরে। উদ্দেশ্য ছিল প্রেমিকার সঙ্গে একসঙ্গে থাকার। পরে তারা দু’জন ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটি সাবলেট বাসা নেন। ওই বাসায় শুরু করেন লিভ টুগেদার। আড়াই মাসের মাথায় তাদের বাসায় ডিশ সংযোগ দিতে আসেন এলাকার এক যুবক। ওই যুবকের মনে সন্দেহ জাগে তারা বিবাহিত কিনা! পাড়ার অন্যান্য যুবকের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে ওই তরুণ ও তরুণীকে রাস্তায় আটকে দেন ডিশ সংযোগ দেয়া ওই যুবক। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের আইফোন ও নগদ টাকা-পয়সা নিয়ে যান। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি ওই যুবক। বিষয়টি জানিয়ে দেন বাড়ির মালিককে। ডাক পড়ে ওই তরুণ-তরুণীর। কিন্তু তারা তাদের বিবাহিত সম্পর্কের কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলাতে পারেননি। পরে বাড়ির মালিকসহ পাড়াপ্রতিবেশীরা তরুণ-তরুণীকে স্থানীয় একটি কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেন। বিয়ের পরে তারা চার মাস সংসারও করেন। এ সময়ে ওই তরুণী ছিলেন আট সপ্তাহের গর্ভবতী। এরই মধ্যে তরুণী তার স্বামীর অস্বাভাবিক কিছু আচরণ লক্ষ্য করেন। তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অমিল ছিল। তাই ওই তরুণী স্বামীকে ডিভোর্স দেন।

আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন, সহকর্মী এক বন্ধুকে নিয়ে আমি পান্থপথ এলাকার একটি মেসে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম থেকেই আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমার যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার লিভ টুগেদারের ইচ্ছা ছিল। আমিও সিদ্ধান্ত নেই একসঙ্গে থাকবো। এক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয় বাসা ভাড়া নিয়ে। পান্থপথ, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান, গ্রিনরোড এলাকার অন্তত শতাধিক বাসা দেখে সুবিধামতো বাসা পাইনি। অনেক সময় বাসার মালিকের নানা প্রশ্ন শুনে চলে আসি। আবার অনেক বাসায় লিভ টুগেদার করাটাকে ঝুঁকি মনে হয়। যেসব বাসায় থাকার মতো অবস্থা ছিল সেখানে আবার ভাড়া বেশি চাওয়া হয়। আমরা দু’জনেই শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। পাশাপাশি ছোট চাকরি করি। একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই কোনোরকম দরকষাকষি না করেই ভাড়া নিই। কারণ, মনে ভয় ছিল বেশি দরদাম করলে হয়তো আর বাসা পাবো না।

সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক অনেকেরই আছে। তবে সেটা কেউ প্রকাশ করে না। ভারতের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- প্রতি ১০ জনের ৮ জনেরই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশেও এরকম অনেক আছে। কিন্তু অনেকেই একসঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকে না। সময়-সুযোগ করে ভালোলাগার মানুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, লিভ টুগেদার করাটা অনেকের শখ। এটা রুচিগত ব্যাপার। বাংলাদেশের আইনে আছে কোনো নারী-পুরুষ যদি একত্রে থাকতে চায় তবে তাকে ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিয়ে করতে হবে। বিবাহিত ব্যক্তি যদি কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে লিভ টুগেদার করে তবে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধানও রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দুনিয়ার সব দেশেই কমবেশি এমন ঘটনা আছে। তবে একেক দেশের ধরন ও চর্চা একেক রকম। কারণ, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ প্রতিটি দেশে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। অনেকেই পরিবার গঠন করে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতে চায় না। এর মূল কারণ হলো- পরিবার মানে দায়িত্ব, আত্মত্যাগ, শেয়ার করা। এখানে একে অন্যের দায়িত্ব নিতে হয়। পছন্দ না হলেও অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। সেক্রিফাইস করতে হয়। একটা সময় মানুষ পতিতালয় বা সেক্সহাউজে গিয়ে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো। কিন্তু এখন এই বিষয়গুলোকে আরও আধুনিক ও সহজ করে লিভ টুগেদার পন্থা বলা হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ তার পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে শারীরিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি একাকিত্ব সময়টাও ভালোভাবে কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে বেশি উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা কমে গেছে। সবাই যে লিভ টুগেদার করছে- এমনটাও না। বিয়ে না করে থাকা বা লিভ টুগেদার কোনোটাকেই আমরা ইতিবাচক ভাবি না। সুত্র: মানবজমিন